kazi ashraful islam

kazi ashraful islam

Friday, May 14, 2010

ছোটগল্প




                        নিসর্গের আলোছায়া
                                               সালেহা সুলতানা











চওড়া রাস্তার দু’পাশ ধরে বিশাল-বিশাল বাড়ি। জাহাজ-সদৃশ অবয়ব নিয়ে বাড়িগুলো দাঁড়িয়ে। বাড়িগুলোর নিচে জলের অস্তিত্ব কল্পনা করলে ওগুলো জাহাজই মনে হবে। গভীর সমুদ্রে ভাসমান জাহাজগুলোয় আলো জ্বলছে। সর্বাংশ আলোকিত নয়; কিয়দংশ অন্ধকারাচ্ছন্নও। ফলত আলো-আঁধারের রহস্যময়তা খেলা করছে।






উপরে রাতের আকাশ- অসীম ও নিস্তব্ধ। জাহাজগুলোর মাথা বেয়ে জল থেকে উঠে আসছে বড় আকৃতির ভৌতিক চাঁদ। চাঁদের তেজে তারাগুলো নিষ্প্রভ। অথচ একটু আগে তারাগুলোই জ্বলজ্বল করে জ্বলছিল। আর এখন জোছনা আর জলের সমাকীর্ণতায় উন্মেষিত নতুন প্রণয়।






সেখানে জল-জোছনার মাখামাখিতে তুচ্ছ ও গৌণ অন্যান্য অনুষঙ্গ। দূরে তীরের অস্তিত্ব অনুভব করতে চায় মন; কিন্তু জাহাজগুলো এত লাগোয়াভাবে দাঁড়িয়ে যে, এর ফাঁক গলিয়ে দৃষ্টিকে অতি-দূর প্রসারিত করা যায় না। শেষতক দৃষ্টি ওই চাঁদের মধ্যেই আটকে থাকে।






জলের ছলাৎ-ছলাৎ শব্দ দূরযাত্রার ভ্রমণ আনন্দকে জাগরিত করে। তবুও আকাশ-সমুদ্রের প্রান্তরেখা দেখার বাসনাকে মাটিচাপা দেওয়া যায় না। ইচ্ছাটা জেগে থাকে ওই চাঁদের মতোই, যা কিনা মেঝের আড়ালেও ঢাকা পড়ে না। জাহাজের স্থিরতাকে একসময় অসহনীয় মনে হয়।






কখন যে জাহাজটা দূর- আরও দূর সীমায় হারিয়ে যাবে; তার অপেক্ষায় অধীর হয় মন। উপরে সীমাহীন আকাশ, নিচে পাতাল-তলের জল- দুয়ের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে মহাকালের বিরাট-বিপুল অস্তিত্বের মধ্যে ক্ষুদ্রতম এই প্রাণকে উপলব্ধি করে বিস্ময়াভিভূত হয়ে পড়ে পুষ্প;- জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে বাতাসের নিঃশ্বাস শোনে।






বাতাসের হাত কি তাকে জড়িয়ে ধরেছে? পেছন থেকে জড়িয়ে ধরার অনুভব অস্তিত্ব পায়। ভীষণ একটা ঘোর থেকে জেগে ওঠে পুষ্প। তার সামনে দৃশ্যমান জাহাজ-সমুদ্র-চাঁদ সব মুছে গিয়ে প্রকটভাবে জেগে থাকে ইট-কংক্রিটের অবয়ব আর চিতানো রাস্তাটা।






সেখানে মুহূর্তে-মুহূর্তে ঘটছে সঙ্গম; যানবাহনের সঙ্গে ওই চিতানো রাস্তার। পুষ্প হাত স্পর্শ করে। তমাল ওকে জড়িয়ে ধরেছে। প্রশস্ত বারান্দার কল্পিত দৃশ্যপট থেকে তমাল পুষ্পকে নিয়ে যায় রাত্রির মতো স্নিগ্ধ অন্ধকারের রহস্যময়তায়। যেখানে ওরা জোছনা ও জলের মতোই মাখামাখিময়।






কিংবা চওড়া বাসাটা এক স্রোতস্বিনী পায়রা নদী। বিশাল-বিশাল বাড়ি নদীর দু’পাড়ে দণ্ডায়মাণ বৃক্ষ। সজীবতায় ছুঁয়ে থাকে নদীর দু’কূল। বাতাসের মৃদু দোলায় বৃক্ষশাখা দোলে। ক্ষণিক থেমে আবারও দোলে। নিবিড় হূদ্যতায় বৃক্ষ-বাতাস কথা কয়। পাখির বিচিত্র কোলাহল শৈশব-প্রাঙ্গণকে জাগিয়ে তোলে।






ফিঙ্গে-দোয়েল আর শালিক পাখির লুটোপুটি খেলা চলে অবিরাম। নদীর নিচে লতা-গুল্মে বারবার ফিরে আসছে লাল ফড়িং। ফড়িংয়ের স্থিরতা মনঃপুত হয় না। বরং স্থানবদল করে নতুন-নতুন লতাকে নির্বাচিত করছে। পায়রা নদীর গহীন গম্ভীর জলে বাতাস উদোম গায়ে ছুটে বেড়ায়।






বাতাসের শরীর পুষ্পের শরীরে জাপটে থাকে। পুষ্প খিলখিল করে হেসে ওঠে। ওর হাসির সুর-লহরি পায়রা নদীর ঢেউয়ে ডুবে-ডুবে যায়। অবিশ্বাস্য গতিতে ভাবনাগুলো রূপ নেয়। পায়রা নদীর উদোম-বাতাসকে পরাজিত করে তমাল পুষ্পকে জয় করে জাপটে থাকার নেশায়।






নদীর ওপর লঞ্চ থেকে তুলে এনে ওকে যেন নতুন আরেকটি লঞ্চে সওয়ার করল তমাল। তবুও তো নদীর বুকে বাতাস ছিল, সবুজ ছিল, ছিল ঢেউয়ের দোলা; এখানে সব, সবকিছু অন্যরকম, যেন অভিশপ্ত কোনও স্থান। কাঠিন্যের শব্দময়তায় বাতাসেরা শ্বাস নেয়, দৃষ্টির সজীবতা পাথুরে-মালিন্যে জমাট বাঁধে।






চাঁদের আলো আকাশ থেকে স্বপ্নডানা মেলে নেমে এলেও এখানে সে-আলো স্নিগ্ধতা হারিয়ে কৃত্রিমতায় লুপ্ত হয়। উদ্বুদ্ধ-কল্পনার জন্ম-রহিত হয় নির্জীব-সত্তার জৌলুসহীন প্রাচীরের নিয়ন্ত্রণে। কিংবা চারপাশের অবিরত মুখগুলোও শূন্যতার প্রসাধনীতে ঘুরে বেড়ায়। মৃতপুরীর মতো অচেনা মানুষগুলোকে দুর্বোধ্য ঠেকে।






নিঃশ্বাস নেওয়ার আকুলতায় পুষ্প হাতড়ে বেড়ায় মনের গহীনে নিঝুম এক দ্বীপকে অথবা পায়রা নদীর জনপদকে- যেখানে পুষ্পের বাড়ি। পুষ্প ঘর থেকে বাইরের উঠোনে দৌড়ে নেমে আসে। নেমে এসে শব্দের উৎস জেনে মাটিতে পা দিয়ে দপ্ দপ্ শব্দ করে। ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাকে কানে তালা লেগে যাচ্ছে।






কিছুক্ষণ থেমে থাকে ওরা। কানটা শান্ত হওয়ায় স্বস্তি পায় পুষ্প। পুনরায় পড়ার টেবিলে যাওয়ার ইচ্ছাটা মরে যায় ফুলের গন্ধে আর চাঁদের আলোয়। উঠানে হেঁটে বেড়ায় পুষ্প। সামনের ধানক্ষেতটা বাতাসে নুয়ে-নুয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে ভেসে আসছে পূজা উপলক্ষে মাইকে বাজানো গান।






আবছা আলোয় ভুতুড়ে খড়ের গাদাগুলোর উপরে কলাবাদুড়ের নিঃশব্দ যাত্রা আকাশপথে। পুষ্প ঘুরে বেড়ায়। প্রকৃতির মাঝে আলো-আঁধারের সান্ধ্যভাষা রূপময় হয়ে উঠেছে। সবুজ ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসে পড়ে পুষ্প। ঘাসের শীতলতায় মনের গ্রন্থিগুলো খুলে পড়ে। প্রকৃতি তার বিবসন-রূপ খুলে দেয়।






উঠানজুড়ে চাঁদের আলোয় গাছের আল্পনা। বসন্তের বাতাস আমের মুকুলের গন্ধে মাদকতায় আচ্ছন্ন। পুষ্পের মনে হয়, সে কোনও এক আদিম অরণ্যচারী মানুষ- প্রকৃতির পাঠ গ্রহণ করছে। কিংবা শবরী বালিকার প্রাচীনতায় সমর্পিত- ‘একেলী সবরী এ বন হিণ্ডই কর্ণকুণ্ডল বজ্রধারী’। জোছনা পাকা কঙ্গুচিনা মদের নেশা ঝরায়।






পুষ্প নেশায় বুঁদ হয়ে নিজেকে প্রকৃতির মাঝে তিল-তিল করে ছড়িয়ে দেয়। পুষ্প ও প্রকৃতি ক্রমশ একীভূত-সত্তায় একাকার হয়ে যায়। কঙ্গুচিনা মদের মাদকতায় পেয়ে বসে তমালকে। পুষ্প উন্মত্ত হতে পারে না।






এখানে নেই মুকুলিত তরু, গহীন গম্ভীর স্রোতস্বিনী, জোছনা-বাটিকার কাপাশ ফুল- উন্মত্তের রসদহারা এই বিবর্ণতায় আত্না জাগরিত হয় না। দেহ-মনকে খুঁজে পায় না। যান্ত্রিকতায় নিহিত শৈল্পিক-সত্তা। এই যান্ত্রিক নিষ্পেষণে নিমজ্জিত হতে-হতে পুষ্পের অন্তরাত্না কেঁদে ওঠে।






একটা সরকারি চাকরির সুবাদে তমাল জীবিকার আশ্রয়ে উপনীত হয় বরিশালে। আজন্ম ঢাকার জল-হাওয়ায় বর্ধিত মানসে শ্যামলিমার আস্তরণ পড়েনি কখনও। চাকরির মধ্যস্থতায় দেখা হয় ধানসিড়ি নদী, চাখার, হাওড়-বিল; জালের মতো বিন্যস্ত জলাশয়গুলোয় প্রতিবিম্বিত আকাশ-বনভূমির রূপ দেখে দেখে প্রকৃতির প্রেমে পড়ে যায় তমাল।






বইয়ে পড়া প্রকৃতির মুখস্থ রূপ যেন বরিশালের মাঠে সশরীরে হাজির। শ্যামলিমার নরম-হাত তমালকে আচ্ছন্ন করে। তমাল অবশ ও বিবসিত হতে থাকে প্রকৃতির ঐশ্বর্যে। এরই মাঝে কুয়াকাটা যাওয়ার আয়োজন চলে।






পৃথিবীর বুকে অন্যতম একটি স্থান কুয়াকাটা- যেখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত একই সঙ্গে দেখার সুযোগ মেলে। এই দুর্লভ মুহূর্ত দেখার ইচ্ছা নিয়ে ওরা কয়েকজন মিলে রওয়ানা হয়। তবে ইচ্ছাটার রূপ দিতে রাস্তার ধকলও সইতে হয় অনেক। সঙ্গী যারা, তাদের অনেকেই পাড়াগাঁ আর মফস্বলের মানুষ।






ওদের জন্য এই কষ্ট সহনীয়। তমাল অনভ্যস্ত বলেই ওর বিরক্তিটাও বেশি। গাড়ি একসময় ফেরিঘাটে পৌঁছে। পায়রা নদীর ঘাট। নদীর নামটা যেমন সুন্দর, তেমনি এর জলের স্বচ্ছতাও চোখকাড়া। তমাল মুগ্ধ হয়। আরও মুগ্ধ হয় কলাপাতা রঙের সালোয়ার-কামিজ পরা এক যুবতীকে দেখে।






মেয়েটি এমন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে যে, চোখ ফেরানো যায় না। হয়তো চোখ ফেরালেই বিপদ ঘটে যাবে। ফেরির একদম কিনার ঘেঁষে মেয়েটি দাঁড়িয়ে। তমালের মনে ভয় হয়, মেয়েটি হয়তো এক্ষণি নদীতে পড়ে এক খণ্ড পাথরের মতো ডুবে যাবে। দু’হাতে বাতাস ছানছে মেয়েটি। তমাল সইতে না পেরে দ্রুত দৌড়ে আসে।






হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে আনে মেয়েটিকে। রাগ না সামলিয়ে ধমকে ওঠে- এই মেয়ে, তুমি এভাবে দাঁড়িয়েছ কেন? মরতে সাধ হয়েছে? মেয়েটি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। ঘটনার আকস্মিকতায় মূল বিষয়টি দ্রবীভূত হতে সময় নেয়। ঘোর ভাঙতেই বলে- আপনি এত ভয় পেয়েছেন কেন? আমি তো রোজই এভাবে ফেরি পার হই।






কী দুঃসাহসী মেয়ে, তমাল মনে-মনে ক্ষিপ্ত হয়। কথায়-কথায় জমে ওঠে ওদের আলাপ। সূর্য তখন মাঝপথ থেকে অনেকটা হেলে এসেছে পশ্চিমে। সূর্য-কিরণের প্রখরতা হ্রাস পেয়ে এখন অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে। একটু পরই অন্যরকম এক স্নিগ্ধতার প্রলেপে জড়াবে পৃথিবী।






পুষ্প আর তমাল সেই চিরন্তন আবেশেই পথ চলতে থাকে। পুষ্প স্নাতক পর্যায়ে পাঠ সমাপ্ত করে বরিশালের একটি কলেজে। শহরে যেতে হলে তাকে ফেরি পার হতে হয়। কেবল বিদ্যার্জনের জন্য শহরে যাতায়াত। গ্রামই তার প্রিয়। পরিপাটি ও নিরিবিলি গ্রাম-মায়ের কোলের মতোই স্নিগ্ধ ও শান্তিময়।






পুষ্পের বাড়িতে টিনের দোতলা ঘর। বাড়ির চারপাশে তাল-সুপারির বন। সুপারি গাছের কাণ্ড গর্ভবতীর মতো পেট ফুলিয়ে সারি-সারি দাঁড়িয়ে। ক’দিন পরই দেখা যাবে পেট ঝরিয়ে বেরিয়ে এসেছে ধবধবে পরিষ্কার ফুলের গোছা। ফুল থেকে একটা পাগল করা বনজ-সৌরভ ছড়িয়ে পড়বে বাতাসে।






সুপারি গাছের ওপারে দূরে ধানকাটা শেষে নিঃসঙ্গ মাঠ পড়ে আছে। সেখানে শালিক পাখিদের কিচিরমিচির। নিঃসঙ্গতায় এই কিচিরমিচির ও কোলাহলের সুখ পোহায়ে নিচ্ছে মাঠ। পুষ্প নিসর্গের মাঝে ডুবে থেকে কেবল নিসর্গের ভাষাই চেনে। চেনে না শব্দ-কোলাহলমুখর জনপদ, যন্ত্রায়ণের প্রলম্বিত শ্বাসাঘাত।






এসব অভ্যস্ততায় সমর্পিত তবুও তমালকে ভালবেসে শহুরে হওয়ার প্রাণান্ত চেষ্টায় জিইয়ে রাখে নিজেকে। তমালের লম্বাটে খুপরির মতো বাড়িতে এসে পুষ্প যেন বন্দি পাখির মতো চারদেয়ালে বারবার ঠোকর খায়। ঘুরে-ফিরে কয়েকটি কক্ষ আর লাগোয়া দরজা। বেল বারান্দায় এসে দাঁড়ালে একটু স্বস্তি মেলে।






আর তখনই সামনের দৃশ্যগুলো হয়ে ওঠে কল্পিত বনভূমি, নদী, সমুদ্র। নিসর্গের মাঝে ডুবে থেকে ভুলে যায় শহর, কোলাহল আর হর্নের চিৎকার। বারবার ফিরে আসে পায়রা নদী, নদীতীরবর্তী গ্রাম, জনপদ, পরিচিত মুখ, পরিচিত উঠান, পুকুর, ধানক্ষেত এমনকী গ্রামের ওপর দিনের বেলায় জেগে-ওঠা আকাশের মরা চাঁদকেও।






পুষ্পের অস্বস্তি লাগে এখানকার বাড়িগুলো দেখে। এখানে নিঃশ্বাস ফেলার জায়গার বড় অভাব। রাস্তার পেট ঘেঁষে দাঁড়ানো বাড়িগুলোয় ঢোকার পর কোনও অবসর পাওয়া যায় না বা অবসর না দিয়েই সিঁড়িভাঙা ক্লান্তিকর কাজে নিয়োজিত হতে হয়। নেই বাগান, গাছগাছালির মায়া।






এক চিলতে উঠানও নেই, যেখানে চাঁদের আলো শান্তিতে লুটিয়ে পড়তে পারে। সবকিছু এত সংক্ষিপ্ত ও সংকীর্ণ যে, মনের বিস্তার ঘটানো যায় না। এখানকার মনগুলোও বনসাই গাছের মতো ক্ষুদ্রতায় আটকে থাকে। পুষ্প তমালকে দেখে। ঝঁপা চকচক নগরের আঁচে বড় হওয়া তমালের মগজে স্মৃতি হয়ে আছে চাকচিক্যের বীজ।






চাকরি ছেড়ে চাকচিক্যের বৃত্তিতেই আগ্রহী হয়েছে তমাল- শেয়ার বিজনেস, এ্যাপার্টমেন্ট বিজনেসসহ নানা কারবারে ব্যাপৃত তমাল বৈষয়িক স্ফীতিকেই জীবন জানে। বিশ্বায়নের ঘোলাজলে মাছশিকারিদের দলে ভিড়ে গিয়ে তথাকথিত উচ্চধাপে ওঠার প্রতিযোগিতায় শশব্যস্ত থাকে।






নিচের দিকে তাকিয়ে নিজের দেশ, নিজের সমাজ এমনকী নিজকে দেখারও ফুরসত মেলে না। পুষ্প উপলব্ধি করে, তমাল আর আগের মতো নেই, যেমন ছিল বরিশালে।


প্রকৃতি হয়তো তাকে শুশ্রূষা করে খানিক দিনের জন্য বদলে দিয়েছিল। বরিশাল ছেড়ে ঢাকায় এসে পুনরায় আগের খোলসে ফিরে এসেছে।






পুষ্প বোঝে, এটাই তমালের প্রকৃত রূপ। তমাল এখন পুষ্পর কাছ থেকে যা চায়, তা দস্যুর মতোই লুটে নেয়, সেখানে থাকে না প্রেমিকের মতো প্রার্থনা বা আর্তি।


পুষ্পকে আমূল পরিবর্তনে নিরন্তর প্রয়াস চালায় তমাল।






দিঘল চুল আর আঁচল টানা শাড়ি এসব ব্যাকডেটেড পন্থায় বিরক্তি ঝাড়ে তমাল- “নিজেকে অ্যাট্রাক্টিভ করে গড়ে তোলো। এসব ফাংশনে-পার্টিতে তোমাকে বেমানান লাগে।” পুষ্প এসব ইঁদুরদৌড়ে যেতে চায় না। ওর নিজস্বতাই ওর সৌন্দর্য। তমাল সেটার মূল্যায়নে অপারগ। সেই মনন-হূদয় তমাল অর্জন করতে পারেনি।






পুষ্প থিতিয়ে পড়ে। তমালকে দেখে। একেবারেই অচেনা। এই শহরের আর অন্যসব মানুষের মতো। মধ্যাহ্নের যে-সূর্য তার উত্তপ্ত কিরণে নদীর জলকে বাষ্প করে কাছে টেনে নেয়, সেই একই সূর্য সামান্য সময়ের ব্যবধানে সে-শক্তি হারায়। তমালও কি তেমনি পুষ্পকে দূরে ঠেলে দিচ্ছে?






পুষ্প তো এমনি রুক্ষ্ম চরে আটকেপড়া কোনও লঞ্চের সওয়ারি হতে চায়নি, তমালই তাকে ভালবাসার সেতু পার করে এখানে নিয়ে এসেছিল। কোথায় সেই ভালবাসা? প্রকৃতির কাছে যা সহজলভ্য, নাগরিক ক্লেদজ-বৈকল্যে তা দুর্লভ। অপমানের অতিশয্যে খণ্ডিত জীবন নিয়ে পুষ্প পড়ে থাকতে চায় না এই শহরে।






তার আদিম প্রকৃতিই তার কাছে অনেক সহজ। যেখানে মানুষ নিজেকে বদলে ফেলে না- আদি ও অকৃত্রিম থাকে আজীবন। পুষ্প মৃত্তিকার ঘ্রাণ নিয়ে মৃত্তিকার ওপর দু’পায়ে দাঁড়াতে চায়। যেখানে পা মেলে দাঁড়ানোর মতো সামান্য মাটি নেই, চোখ মেলে তাকানোর জন্য গুচ্ছ ঘাসের সজীবতা নেই, সেখানে পুষ্পের দুর্ভিক্ষপীড়িত মন বাঁচতে পারে না। এই কাঠিন্য আর রুক্ষ্মতাকে ত্যাগ করে পুষ্প প্রকৃতির আশ্রয়ে নিঃশ্বাস নিতে চায়।






আদিম কোনও গুহাচারী মানুষ কিংবা শর্বরী বালিকার মতো উঁচু পর্বত গাত্রে মনের আনন্দে যাপিত জীবনে ফিরে যেতে চায়। হতে চায় শবরপা রচিত সেই বালিকার মতো- উষ্ণা উষ্ণা পাবত তহি বসই সবরী বালি/ মোরঙ্গ পাচ্ছি পরিহান সবরী গীবত গুঞ্জরি মালী।
















No comments:

Post a Comment