'গোপন কর্মসূচির' মাধ্যমে ঢাকায় 'গুপ্ত হামলার' অভিযোগে সরকারের 'কঠোর চাপের মুখে' পড়েছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। ওই ঘটনার পর থেকে সরকার আর কোনো কর্মসূচিই পালন করতে দিচ্ছে না দলটিকে। পরপর তিনটি কর্মসূচিই পণ্ড করে দিয়েছে পুলিশ। দলের নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয় 'কার্যত' পুলিশ অবরুদ্ধ করে রাখছে। কার্যালয়ের সামনেও দলের নেতাকর্মীরা দাঁড়াতে পারছেন না। সরকারের এই মারমুখী আচরণে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছেন দলের নেতাকর্মীরা। সহিংসতার অভিযোগে ১১ মামলায় ৭ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করে মামলা করা হয়েছে। ফলে গ্রেফতার এড়াতে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন স্থানীয় নেতারা। মহাজোট সরকারের তিন বছরের শাসনামলে সরকারবিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে এমন বেকায়দায় পড়েনি বিএনপি। মূল দলের করুণ অবস্থায় চারদলীয় জোটের শরিক ও সমমনা দলগুলোর নেতাকর্মীরাও এখন গা বাঁচিয়ে চলছেন।
জানা গেছে, এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটিয়ে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি হাইকমান্ড। দলের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দল নিরসন, নিষ্ক্রিয় নেতাকর্মীদের সক্রিয়, মামলা-হামলার ভয় ও বাধাবিঘ্ন উপেক্ষা করে এগিয়ে আসা এবং জনগণকে সম্পৃক্ত করে আন্দোলন জোরদার করে দলকে প্রস্তুত করতে চান তারা। এ লক্ষ্যে শিগগির সাংগঠনিক সফরে যাবেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। গতকাল দলের ভারপ্রাপ্ত
মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দলের যুগ্ম মহাসচিব ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার এক জরুরি বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেন। একইসঙ্গে আগামী ৮-৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চ সফল করতেও জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বিরোধী দল।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেন, মহাজোট সরকার জনগণের মৌলিক অধিকার হরণ করছে। মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান কেন্দ্র করে সরকার পুলিশকে দিয়ে বিরোধী দলের শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক কর্মসূচি পালনে বাধা দিচ্ছে। সরকার ফ্যাসিস্ট চরিত্র ধারণ করেছে দাবি করে তিনি বলেন, জনগণকে সঙ্গে নিয়ে ব্যর্থ সরকারের বিরুদ্ধে কঠোর আন্দোলন গড়ে তুলবেন। গণজোয়ারের মুখে সরকারের সব বাধাবিঘ্ন উড়ে যাবে বলে হুশিয়ারি উচ্চারণ করেন ফখরুল।
অবশ্য আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, যুদ্ধাপরাধী এবং নিজের দুই ছেলে তারেক-কোকোর বিচার বানচাল করতে খালেদা জিয়া দেশকে অস্থিতিশীল করতে চাচ্ছেন। বিরোধী দল যখন শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করেছে তখন পুলিশ বাধা দেয়নি। পুলিশ জনগণের জানমাল রক্ষায় এখন বিরোধী দলকে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম চালাতে দিচ্ছে না। সরকার কাউকে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি করতে দেবে না।
গত ১৮ ডিসেম্বর ভোরে আকস্মিকভাবে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে বোমা বিস্ফোরণ, ভাংচুর, গাড়িতে অগি্নসংযোগে একজন নিহত হন। একই সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ এবং সিলেটে বাসে অগি্নসংযোগে এক যাত্রী অগি্নদগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। সরকারের মন্ত্রীরা ও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে বিএনপি পরিকল্পিতভাবে এ গুপ্ত হামলা চালিয়েছে। তবে বিএনপি নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, সংবর্ধনা নিতে আসা মুক্তিযোদ্ধাদের 'রিসিভ' করতে বিএনপি কর্মীরা সমবেত হলে পুলিশ হামলা চালিয়েছে।
এ ঘটনার পর থেকে 'হার্ডলাইন' অবস্থান গ্রহণ করে মহাজোট সরকার। পরপর দুটি কর্মসূচি পুলিশি বাধায় পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর গতকাল শনিবার তৃতীয় কর্মসূচি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে থানায় থানায় বিক্ষোভ মিছিলে বাধা দিয়েছে পুলিশ। আগামীকাল সারাদেশের জেলায় জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ করার কর্মসূচি রয়েছে।
সরকারের এ 'কঠোর' অবস্থানের মুখে আগামী ৮-৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম অভিমুখে দলের রোডমার্চে ব্যাপক লোক সমাগম ঘটিয়ে সফল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। বৃহস্পতিবার রাতে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেয় দলটি। বৈঠকে পুলিশি বাধায় দলের কর্মসূচি পণ্ড হয়ে যাওয়ার পর চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চ কর্মসূচিতে বাধা দেওয়ার আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন নেতারা। তবে কর্মসূচিতে 'জনগণের ব্যাপক সম্পৃক্তি'র মাধ্যমে সব ধরনের বাধাবিঘ্ন অতিক্রম করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বৈঠকে। চট্টগ্রাম রোডমার্চ সফল করতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ও রোডমার্চের প্রধান সমন্বয়কারী এম কে আনোয়ারের নেতৃত্বে আজ কুমিল্লা ও ফেনী এবং আগামীকাল চট্টগ্রামে প্রস্তুতি সভা করবেন দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা।
বিএনপির কয়েকজন নেতা সমকালকে জানান, সরকার পুলিশ দিয়ে পরপর কয়েকটি কর্মসূচি পালন করতে দেয়নি। এ পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম অভিমুখে রোডমার্চে সরকার বাধা দিতে পারে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন। বাধা এলেও যাতে রোডমার্চ সফল করা যায় তা নিয়ে বৈঠকে কৌশল নির্ধারণ করা হয়।
ঘুরে দাঁড়াতে শিগগির সাংগঠনিক সফরে যাবেন নেতারা : সরকারের কঠোর চাপের মুখে দলকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করতে গতকাল বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সভাপতিত্বে যুগ্ম মহাসচিব ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা জরুরি বৈঠকে মিলিত হন। বৈঠকে শিগগির জেলা বিএনপির দ্বন্দ্ব-কোন্দল নিরসন করে নতুন ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করার সিদ্ধান্ত হয়। একইসঙ্গে নিষ্ক্রিয় ও কমিটি থেকে বাদ পড়া নেতাদের কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করে দলকে আরও শক্তিশালী ও গতিশীল করার সিদ্ধান্ত নেন তারা। এ লক্ষ্যে শিগগির যুগ্ম মহাসচিবদের নেতৃত্বে শিগগির জেলা সফরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। দু'একদিনের মধ্যে দলের চেয়ারপারসনের সঙ্গে আলোচনা করে দিনক্ষণ চূড়ান্ত করা হবে।
বৈঠকে দলের যুগ্ম মহাসচিব আমানউল্লাহ আমান, মিজানুর রহমান মিনু, বরকতউল্লাহ বুলু, মোঃ শাহজাহান, ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন, রিজভী আহমেদ, সাংগঠনিক সম্পাদক ফজলুল হক মিলন, গোলাম আকবর খোন্দকার, মশিউর রহমান ও মজিবুর রহমান সরোয়ার উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে কোনো প্রেস ব্রিফিং করা হয়নি।
বৈঠক সম্পর্কে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব বরকতউল্লা বুলু সমকালকে বলেন, শিগগির সাংগঠনিক সফরের মাধ্যমে যেসব জেলায় নতুন ও পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন বাকি আছে_ তা সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। দলকে আন্দোলন ও নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত করতে সাংগঠনিক কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়েছে।
অপর যুগ্ম মহাসচিব মোঃ শাহজাহান বলেন, রোডমার্চে জনগণের যে ইতিবাচক সাড়া মিলেছে তাকে সামনে রেখে দলকে আরও গতিশীল করতে প্রস্তুত তারা। ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন বলেন, বিএনপির পাশাপাশি সহযোগী সংগঠনগুলোকে সাংগঠনিকভাবে গতিশীল করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।