তারা জানিয়েছেন, বিএনপি-জামায়াত পৃথকভাবে এই পরিকল্পনা গ্রহণ করলেও রোববার রাজধানীতে বোমাবাজি, ভাংচুর, গাড়িতে আগুন ও পুলিশের ওপর হামলাসহ সব ধরনের তা-বে তারা সম্মিলিতভাবে অংশ নেন। বোমা-ককটেল দিয়ে একে অপরকে সহায়তা করার কথাও তারা স্বীকার করেন তারা।
গ্রেপ্তারকৃত বিএনপি-জামায়াতের একাধিক নেতা পুলিশি রিমান্ডে গোয়েন্দাদের জানান, রোববার ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে তা-ব চালানোর পর ধরপাকড় শুরু হলে সংঘবদ্ধভাবে মাঠে নামা কঠিন হবে এ বিষয়টি মাথায় রেখেই চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে যাওয়ার ছক তৈরি করা হয়। বিষয়টি সমন্বয়ের দায়িত্বও আগেভাগেই নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে বলে গ্রেপ্তারকৃতরা গোয়েন্দাদের কাছে স্বীকার করেছেন।
তদন্তে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা সূত্রগুলো জানায়, গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে বিএনপি-জামায়াতের বেশ কয়েকজন প্রথম সারির নেতার নাম পাওয়া গেছে। তারাই মূলত আড়ালে থেকে চোরাগোপ্তা হামলার সমন্বয় করছেন। তদন্তের স্বার্থে গোয়েন্দারা তাদের নাম ও সংখ্যা জানাতে চাননি।
তবে দায়িত্বশীল একটি সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আব্দুস সালাম, যুবদল সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি হাবিব উন নবী সোহেল, সাধারণ সম্পাদক সরাফতউল্লাহ সফু, ছাত্রদল সভাপতি সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যুগ্ম-আহ্বায়ক ওবায়দুল হক নাসিরসহ বিএনপি এবং এর অঙ্গ সংগঠনের নেতার টেলিফোন ট্র্যাকিং করা হচ্ছে। তাদের গতিবিধি মনিটরিংয়েরও নির্দেশ রয়েছে।
এদিকে জামায়াতের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক তাসনীম আলম, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য অধ্যক্ষ ইজ্জত উল্লাহ এবং জামায়াতের ভারপ্রাপ্ত আমির মকবুল আহমেদ, নায়েবে আমির মওলানা একেএম ইউসুফ, আবদুস সোবহান, একেএম নাজির আহমদ, জামায়াতের ঢাকা মহানগর কমিটির আমির রফিকুল ইসলাম খান, সেক্রেটারি হামিদুর রহমান আযাদ, সহকারী সেক্রেটারি নুরুল ইসলাম, মওলানা আবদুল হালিম, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সভাপতি ফখরুদ্দিন মানিক ও সেক্রেটারি দেলোয়ার হোসেন এবং এদের সেকেন্ড-ইন কমান্ডদের টেলিফোন ট্র্যাকিংয়ের পাশাপাশি তাদের গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে।
তদন্তে সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, গত রোববার পুলিশের গাড়িতে অগি্নসংযোগ, বোমাবাজি, ভাংচুর ও পুলিশের ওপর হামলাসহ নানা তা-বের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ১১৯ জন নেতাকর্মীকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এদের কেউ কেউ মুখে কুলুপ এঁটে থাকলেও অনেকেই নির্দ্বিধায় তা-বের কথা স্বীকার করেছেন। তারা জানিয়েছেন, দলের শীর্ষ নেতাদের নির্দেশেই তারা পুলিশের ওপর হামলা চালান। অংশ নেন বিভিন্ন নাশকতামূলক কর্মকা-ে, যা পুরোটাই ছিল পূর্ব পরিকল্পিত।
এছাড়াও পুলিশ ও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমের ভিডিও ফুটেজ, স্থিরচিত্র, মোবাইল ফোনের কললিস্ট, আহত পুলিশ সদস্যদের বক্তব্য পর্যালোচনা করে পল্টন তা-বে অংশগ্রহণকারী ও মদদদাতাদের চিহ্নিত করা হয়েছে।
গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, জিজ্ঞাসাবাদে বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন গ্রেপ্তারকৃত বিএনপি-জামায়াত নেতারা। তারা জানিয়েছেন, পুলিশবাহিনীকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তুলতেই পরিকল্পিত এ হামলা চালানো হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাধাগ্রস্ত করতেই রাজপথে তারা শোডাউন করেন। পরে বিভিন্ন উস্কানিমূলক কর্মকা-ের মাধ্যমে তা-ব পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়।
মনিরুল ইসলাম আরো বলেন, দ্রুত বিচার আইনের যে অপরাধ সেটার অনেকগুলো সাক্ষ্যপ্রমাণই আছে- যা ইতোমধ্যেই সংগৃহীত হয়েছে। রিমান্ডে থাকা বিএনপি জামায়াতের নেতাকর্মীদের নগরজুড়ে তা-বে অংশগ্রহণ ও মদদ দেয়া সংক্রান্ত জবানবন্দি রেকর্ড করেছেন গোয়েন্দারা। এছাড়াও তাদের দেয়া তথ্য-উপাত্ত ক্রসচেক করে গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ মিলেছে।
পুলিশি রিমান্ডে গ্রেপ্তারকৃত বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা জানান, হরতাল-লংমার্চ করে রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত করতে না পারায় সরকারের পতন ঘটানোর জন্য তা-ব চালানোর এ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। এই ছক বাস্তবায়ন করার জন্য দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে সশস্ত্র চরমপন্থী সন্ত্রাসীদেরও ভাড়া করে ঢাকায় আনা হয়। চট্টগ্রামের শিবিরপন্থী অর্ধশতাধিক শীর্ষ ক্যাডারকেও সংযুক্ত করা হয়েছিল এই পরিকল্পনার সঙ্গে। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, সাভার ও টঙ্গীসহ ঢাকার উপকণ্ঠের কয়েকটি মাদ্রাসায়ও সশস্ত্র শিবির ক্যাডারদের প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। কিন্তু আকস্মিক এ হামলার শুরুতেই পুলিশ সক্রিয় হয়ে ওঠলে তাদের ছক অনুযায়ী তা-ব চালানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় তারা চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়েই সরে যাওয়ার চেষ্টা চালায়।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, বিএনপি-জামায়াত চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলে গ্রেপ্তারকৃতরা যে তথ্য দিয়েছেন তার সত্যতা পাওয়া গেছে। সোর্সের মাধ্যমে এ ব্যাপারে চাঞ্চল্যকর বেশকিছু তথ্য-উপাত্ত উদ্ঘাটন করা হয়েছে।
এদিকে সোমবার রাত ১১টা ২০ মিনিটে ধানম-ির সায়েন্সল্যাবরেটরি রোডের মাল্টিপ্ল্যান কমপ্লেক্সের সামনে চোরাগোপ্তা হামলা চালানো হয়। অজ্ঞাত সন্ত্রাসীরা এ সময় সেখানে রাস্তার পাশে পার্ক করে রাখা একটি ট্যাক্সিক্যাবে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে কেউ হতাহত না হলেও গাড়িটি পুড়ে ভস্মীভূত হয়। প্রায় একই সময় নিউমার্কেট ফুটওভার ব্রিজ, ধানম-ি ও মোহাম্মদপুরে বেশ কয়েকটি বোমা বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়।
গোয়েন্দাদের ধারণা, বিএনপি-জামায়াতের ক্যাডাররা চোরাগোপ্তা হামলা চালানোর জন্য সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে নগরীতে র্যাব-পুলিশের টহল জোরদার, মোবাইল চেকপোস্ট এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার বাসা-বাড়ি, বস্তি ও বিভিন্ন আবাসিক হোটেলে তল্লাশি অভিযান চলায় তারা ছক অনুযায়ী হামলা চালাতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
ডিএমপি কমিশনার বেনজির আহমেদ জানান, চোরাগোপ্তা হামলা ঠেকাতে পুলিশ সর্বোচ্চ সর্তক রয়েছে। রাজধানীর গুরুতপূর্ণ স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। একই সঙ্গে সন্দেহভাজন বোমাবাজ, অগি্নসংযোগকারী ও ভাংচুরসহ বিভিন্ন নাশকতার সঙ্গে জড়িতদের ধরপাকড় অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
No comments:
Post a Comment