ব্রাজিল-স্পেন ফাইনাল?
আখতার হোসেন খান তারিখ: ১১-০৬-২০১০
বিশ্বকাপ হাতে পেলে-বেকেনবাওয়ার-ম্যারাডোনা-জিদান। এবার কার হাতে ট্রফি?
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এই বিশেষ সংখ্যাটি যখন আপনার হাতে পৌঁছেছে, তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আফ্রিকা মহাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। আজকের দিনে বিশ্বকাপ আক্ষরিক অর্থেই ‘গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ’। কোটি কোটি টাকার আয়োজন, অপরিসীম আনন্দ আর কোটি কোটি টাকার ব্যবসা।
একসময় এই বিশ্বকাপের নিমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেওয়ার মতো সাহস দেখাত দলগুলো। আদিতে ১৬ দলের বিশ্বজোড়া প্রতিযোগিতা আজ পরিণত হয়েছে ৩২ দলের বর্ধিত মনকাড়া, হূদয়হারা এমন এক যুবযুদ্ধে, যা থেকে কোনোক্রমেই আর দূরে থাকা সম্ভব নয়।
সারা দুনিয়ায় খেলোয়াড় সরবরাহকারী আফ্রিকা ২০০৬-এর বিশ্বকাপ অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পেতে পেতে পায়নি। ২০১০ তাই কালো মহাদেশের স্বপ্নপূরণের বছর। সেই স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাদের সেরা তারকা দ্রগবা-এসিয়েন-ইতোদের বিশ্বকাপ-জয়ের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন আফ্রিকা মহাদেশ বহন করবে আগামী এক মাস।
দক্ষিণ আফ্রিকার নয়টি শহরের দশটি স্টেডিয়ামে ৩১ দিনব্যাপী এই প্রতিযোগিতার ৬৪টি খেলা নির্ধারণ করবে পরের চার বছরের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। আফ্রিকা মহাদেশে বিশ্বকাপ এই প্রথম, এই নিয়ে ‘কালো’ মহাদেশে এক দারুণ উদ্দীপনা। ‘জনগণের খেলা’ বা ‘সুন্দর খেলা’ নামধারী ফুটবলের নবজাগ্রত শক্তি আফ্রিকায় তাই আয়োজনেই নয়, জয়ের স্বপ্নেও সবাই বিভোর। দক্ষিণ আফ্রিকা, আইভরিকোস্ট, ঘানা বা নাইজেরিয়া যেকোনো অঘটন ঘটাতে সক্ষম।
ইউরোপিয়ান লিগের ক্লাবগুলোতেই শুধু নয়, জাতীয় দলগুলোতেও ক্রমাগত বাড়ছে আফ্রিকা থেকে আগত অভিবাসী খেলোয়াড়ের সংখ্যা। গায়ে-গতরে বা দক্ষতায় তাঁরা স্থানীয়দের সঙ্গে সমানভাবে পাল্লা দেন। আইভরিকোস্টের দিদিয়ের দ্রগবার মতো কজন আছেন পুরো ইউরোপে? ঘানার দুঃখ, দলীয় প্রশিক্ষক-বর্ণিত ‘অন্য গ্রহের খেলোয়াড়’ মাইকেল এসিয়েনকে ছাড়াই তারা আসছে বিশ্বকাপে।
তথাপি ফর্মের হিসাবে চিরন্তন ব্রাজিল এখনো এগিয়ে ফিফা বা বাজিকরদের খাতায়। ২০০২-এর রোনালদো, রিভালদো বা রোনালদিনহোর মতো কেউ নেই এই দলে। কাকার শারীরিক অবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ, লুইস ফ্যাবিয়ানো আর নিলমার ২০০৮ সালে কনফেডারেশনস কাপে অনেক গোল করার পরও মেসি-ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, তোরেস বা দ্রগবার মতো নন। তবু ব্রাজিলের আছে শক্ত রক্ষণভাগ; অত্যন্ত উঁচু মানের গোলরক্ষক আর আছে পাঁচবার বিশ্বকাপ জেতা এবং সবগুলো বিশ্বকাপে খেলার অনন্য ঐতিহ্য।
সম্ভাব্য বিজয়ীদের খাতায় প্রথম কাতারে আরও আছে ২০০৮ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়ন স্পেন। ইনিয়েস্তা, জাভি আর আলোনসোর সমন্বয়ে গড়া মাঝমাঠের সামনে ফরোয়ার্ড হিসেবে তোরেস-ভিয়ার উপস্থিতি যেকোনো রক্ষণভাগের জন্য ত্রাস। আছে ওয়েইন রুনি, রিও ফার্ডিনান্ড, ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের ইংল্যান্ড; শিরোপাধারী ইতালি, নতুন বলে বলীয়ান হল্যান্ড; আর সব সময় যাদের হিসাবের মধ্যে রাখতে হয়, সেই জার্মানি।
লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা তো অবশ্যই আসবে বিবেচনায়। মেসি অনেকেরই বিবেচনায় দুনিয়ার সেরা খেলোয়াড়। অনেকেরই আবার ধারণা, এ মুহূর্তে ছিয়াশির ম্যারাডোনা নন, ১৯৮২-এর ম্যারাডোনার পর্যায়ে আছেন তিনি। আর্জেন্টিনার পক্ষে মেসির এখন পর্যন্ত অর্জন তাঁর বার্সেলোনার অর্জনের ধারে-কাছে যায়নি। তবু সন্দেহ নেই, সারা দুনিয়ার চোখ থাকবে তাঁর দিকে। প্রায় কাছাকাছি বয়সের ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো বা ওয়েইন রুনি আর ফার্নান্দো তোরেস কিংবা দিদিয়ের দ্রগবা কোনো বিচারেই কম নন, কিন্তু সবার নজর ওই আর্জেন্টাইনের দিকেই: তাঁকে ধরা হচ্ছে বর্তমান যুগের ম্যারাডোনা ।
ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক। গত আঠারোটি কাপ জিতেছে সাতটি দেশ: ব্রাজিল (৫ বার), ইতালি (৪), জার্মানি (৩), উরুগুয়ে (২), আর্জেন্টিনা (২), ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স একবার করে। ১৯৫০ পর্যন্ত চারটি বিশ্বকাপের ভাগাভাগি হয় উরুগুয়ে (প্রথম ও চতুর্থটি) ও ইতালির মধ্যে। ১৯৫৪তে জার্মানি যুক্ত হয় তালিকাতে, ১৯৫৮তে ব্রাজিল, ১৯৬৬তে ইংল্যান্ড, ১৯৭৮-এ আর্জেন্টিনা আর ১৯৯৮-এ ফ্রান্স। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা আর ফ্রান্সের তালিকাভুক্তির বছরটি নিয়ে একটা গাণিতিক সূত্রও বের করা যেতে পারে: দশকের অষ্টম বছরে একটি আরেকটির চেয়ে বিশ বছর পরে পরে।
১৯৯৮ সাল থেকে কায়েম হওয়া সাত দেশের ‘ক্লাব’ এবার আটে উত্তীর্ণ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে: স্পেন স্মরণকালের সেরা দল নিয়ে হাজির হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, আর্সেনাল আর লিভারপুলের তারকাদের পদচারণে মুখর স্পেনের জাতীয় দল। তোরেস, ফ্যাব্রিগাস, ইনিয়েস্তা, ক্যাসিয়াস, আলোনসো, জাভি প্রমুখে সমৃদ্ধ ২০০৮-এর ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন স্পেন এবার বাছাইয়ের অবস্থানে চিরন্তন শীর্ষ বাছাই ব্রাজিলের সমানে সমান। গত ডিসেম্বরে ড্রর দিনই তাই এক স্বাপ্নিক তো লিখেই ফেললেন, ফাইনাল হবে ব্রাজিল ও স্পেনের, আর সে ফাইনাল টাইব্রেকারে গড়াবে। ফুটবলের অপূর্ণ অতি সম্ভাবনার দেশ স্পেন: যে দেশের ফুটবলের মান নির্ধারিত হয় রিয়াল মাদ্রিদ আর বার্সেলোনার মতো ক্লাব দ্বারা, তাদের অনেক আগেই বিশ্বকাপ জেতা উচিত ছিল।
স্পেনের অল্প পেছনেই আছে হল্যান্ড: দুবার বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা ডাচরা সত্তরের দশকের মতো ক্রুইফ, নিসকেন্স, রেপ, আরি হান পর্যায়ের খেলোয়াড় আর ‘টোটাল ফুটবল’ নিয়ে গর্ব করতে না পারলেও বাছাইপর্বে তাদের খেলা ছিল স্পেন আর ইংল্যান্ডের মতোই তুখোড় আর সম্ভাব্য বিজয়ীর মতোই। ইউরোপের সেরা দলগুলোর মতোই ডাচরাও যেকোনো উচ্চতায় উঠতে সক্ষম: ১৯৭৪ সালে তাদের বিশ্বকাপ জেতা যুক্তিসংগত ছিল। কেন পারেনি, তা আজ ইতিহাসের গবেষণার বিষয়, কিন্তু ১৯৭৮ সালেও যে দল নিয়ে ওরা শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তাই বা কম কিসে। আজকের ডাচ দলে ইন্টার মিলানের স্নাইডার, বায়ার্ন মিউনিখের আরিয়েন রোবেন, লিভারপুলের ডার্ক কিউট, রিয়াল মাদ্রিদের রাফায়েল ফন ডার ভার্ট আর আর্সেনালের ফন পার্সির মতো খেলোয়াড়েরা বিশ্বের যেকোনো দলে জায়গা করে নেওয়ার মতো তারকা।
ইউরোপ থেকে আসা আরেক শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ড। পৃথিবীর অন্যতম সেরা ফরোয়ার্ড রুনির ওপরই ভর করে নেই তারা; জেরার্ড, ল্যাম্পার্ড, টেরির মতো খেলোয়াড়েরাও আছেন ইংল্যান্ড দলে। ‘সি’ গ্রুপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আলজেরিয়া আর স্লোভেনিয়ার সঙ্গে খেলে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হবে ইংল্যান্ড, সবার তা-ই প্রত্যাশা। ইংল্যান্ডকে অবশ্য ১২ জুন রাস্টেনবার্গের রয়াল বাফোকেং স্টেডিয়ামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাধা পেরোতে হবে। তারা অবশ্যই ১৯৫০ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্বকাপে মার্কিনদের হাতে অপদস্থ হওয়াটাও মনে রাখবে। ইংল্যান্ডের বিজয় এতই অনিবার্য ধরা হচ্ছিল যে যখন পত্রিকা অফিসে প্রথম ওই ১-০ মার্কিন বিজয়ের খবর যায়, অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, ফলাফলটা ইংল্যান্ডের পক্ষে ১০-১ হয়েছে। বেলো হরিজেন্তের ওই আপসেট বিশ্বকাপ-গাথার অংশ হয়ে আছে।
গ্রুপে প্রথম না হতে পারলে ইংল্যান্ডকে ১৬-এর রাউন্ডেই ‘ডি’ গ্রুপের সম্ভাব্য শীর্ষ দল জার্মানির মুখোমুখি হতে হবে। এবং সন্দেহ নেই, সেটা কোনো সুখকর জিনিস নয়।
ইতালিসহ জার্মানি বিশ্বকাপে সচরাচর সম্ভাবনার প্রথম কাতারের দল। জার্মানি ব্রাজিলের মতোই সাতটি ফাইনাল খেলেছে। ইতালি বর্তমানের চ্যাম্পিয়ন। দুটি দেশই ইউরোপের বিভিন্ন লিগে খেলা অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ে ভরা। কে জানত ১৯৮২তে ব্রাজিলকে টপকে ইতালি ফাইনাল খেলবে। তেমন উল্লেখ্য দল ছিল না ১৯৮২, ১৯৮৬ বা ২০০২ সালে, কিন্তু তাই নিয়ে জার্মানি যে ফাইনালে যাবে, তা-ই বা কোন হিসাবে ছিল। একই কথা ইতালিকে নিয়ে। সারা দুনিয়া যখন ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা বা অন্য কাউকে নিয়ে হইচই করে, ইতালি বা জার্মানি সিঁধেল চোরের মতো সন্তর্পণে এসে সেমিফাইনালে বা ফাইনালে ঢোকে কিংবা শিরোপাও জিতে নেয়।
ফুটবলে সাম্প্রতিক কালে এক বিপ্লব ঘটেছে। এটা মূলত ইউরোপ-ভিত্তিক (ক্রিকেটে যা হয়েছে ভারতে)। গত বিশ বছরে ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোর চাহিদার প্রয়োজনে সারা দুনিয়া বিশেষত দক্ষিণ, মধ্য ও উত্তর আমেরিকা এবং আফ্রিকা থেকে খেলোয়াড় এসে বোঝাই হচ্ছেন ইউরোপে। অস্ট্রেলিয়াও বাদ নেই এই সরবরাহ-কর্ম থেকে। বিশেষত আফ্রিকার দারিদ্র্য এবং একই সঙ্গে এর যুবশক্তির দৈহিক যোগ্যতা ও ফুটবল-দক্ষতা ঝাঁকে ঝাঁকে আফ্রিকানকে ইউরোপে টেনেছে। অনেকেই অভিবাসী হয়েছেন এবং অভিবাসী না হয়েও অন্যান্য মহাদেশেও তাঁরা খেলছেন। অনেকে কৌশল ও মানের বলে নিজ জাতীয়তা বজায় রেখেই সারা দুনিয়ায় সগর্বে খেলে বেড়াচ্ছেন। দ্রগবা, এসিয়েন, ইতো এঁদেরই অন্যতম। যাঁরা অভিবাসী, তাঁরাও জাতীয় দলে জায়গা করে নিচ্ছেন। জিদানের কথা বাদই গেল; পর্তুগাল বাদে বিশ বছর আগে ইউরোপের কোনো জাতীয় দলে কালো খেলোয়াড় পাওয়া দুষ্কর ছিল। সেই চিত্র আজ অনেক পাল্টে গেছে। টেলিভিশন-বিজ্ঞাপনের টাকার টানে আর বিদেশি বিনিয়োগে ইংল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি আর স্পেন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ক্লাবগুলোর আখড়া।
এরই একটা ফল হলো এসব দেশ থেকে খুব কম ভালো খেলোয়াড় বাইরে যান। এবারের বিশ্বকাপে স্পেনের ২৩ জনের মধ্যে মাত্র তিনজন বাইরে খেলেন; লিভারপুলের তোরেস ও রেইনা আর আর্সেনালের সেস ফ্যাব্রিগাস। চোখে পড়ার মতো উল্লেখ্য বিষয় হলো, তিনটি দল পুরোপুরি স্বদেশি ক্লাবের খেলোয়াড়ে তৈরি—ইংল্যান্ড, ইতালি আর জার্মানি। পয়লা জুন রাতে ফিফার প্রকাশিত প্রতিটি জাতীয় দলের ২৩ জন খেলোয়াড়ের তালিকায় দেখা যায় এমনকি উত্তর কোরিয়ারও তিনজন খেলোয়াড় (হং ইয়ং-জো, আন ইয়ং-হাক ও জং তা-সে) বিদেশি ক্লাবে (প্রথম জন রাশিয়ায় আর অন্য দুজন জাপানে) খেলেন। ইংল্যান্ড, ইতালি আর জার্মানি সম্ভবত পশ্চিমা দুনিয়ার ফুটবল-বিপ্লবের প্রতীক, তেমনি এর সহজাত জনসংখ্যা-ঘাটতির বোঝা সবচেয়ে বেশি বহন করে চলছে।
আটটি গ্রুপের দলগুলোকে ফিফার সিডিং-ভিত্তি মোটামুটি মাথায় রেখে কাপ-যুদ্ধের একটা আনুমানিক দৃশ্য আঁকা যায় আগামী এক মাসের জন্য। ‘এ’ গ্রুপে দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো, উরুগুয়ে বা ফ্রান্স ‘জি’ গ্রুপের মতোই, যদিবা একটু কম শক্তিমত্তার, আরেক ‘গ্রুপ অব ডেথ’। দুবার বিশ্বকাপজয়ী উরুগুয়ে ১৯৭০-এর পরে আর সেমিফাইনালেও যায়নি। ফ্রান্স ২০০৬-এর রানার্স-আপ এবং থিয়েরি অঁরির হ্যান্ডবল গোলে চূড়ান্ত পর্বে এলেও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, চেলসি, আর্সেনাল, বায়ার্ন মিউনিখ আর সেরা ফরাসি ক্লাবগুলোর খেলোয়াড় নিয়ে গড়া ফরাসি দলকে যতটা সম্ভাবনা থেকে দূরে ভাবা হয়, কার্যত তা নয়। প্যাট্রিস এভরা, ফ্রাঙ্ক রিবেরি আর নিকোলাস আনেলকা বিশ্বখ্যাত।
দক্ষিণ আফ্রিকা তার পুরো মহাদেশের চ্যালেঞ্জের নেতৃত্ব দেবে (অন্যদের মধ্যে থাকবে ‘জি’ গ্রুপের আইভরিকোস্ট, ‘বি’ গ্রুপের নাইজেরিয়া আর ‘ডি’ গ্রুপের ঘানা)। শেষ মুহূর্তে এসে সর্বোচ্চ গোলদাতা ম্যাকার্থি বাদ পড়েছেন চূড়ান্ত ২৩ থেকে, তবে আছেন স্টিভ পিয়েনার। স্বাগতিক দেশ হওয়ার যে সুবিধা দক্ষিণ আফ্রিকার আছে, বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলীয় কোচ কার্লোস আলবার্তো পাহেইরার প্রশিক্ষণে তা পিয়েনাররা কতটুকু সামনে নিয়ে যাবেন, তার জন্য অধীর হয়ে আছেন স্বাগতিক দেশের লক্ষ-কোটি সমর্থক।
ধরে নেওয়া যেতে পারে, ১৬-এর রাউন্ডের জন্য ফ্রান্সই থাকবে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে। উরুগুয়ে বা মেক্সিকোর বিপক্ষে তেমন কিছু বলার যেমন নেই, তেমনি পক্ষেও খুব বলার নেই। ডিয়েগো ফোরলান উরুগুয়ের সেরা খেলোয়াড়; অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের পক্ষে এবার তিনি এক সাফল্যময় মৌসুম পেরিয়ে এসেছেন; সে উচ্চতা তিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পক্ষেও পাননি। আরও আছেন ইউরোপীয় ও অন্যান্য লীগের খেলোয়াড়। এর পরও বলা যায়, ফ্রান্স ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে ডিঙিয়ে মেক্সিকো-উরুগুয়ের পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়া দুষ্কর। তা ছাড়া আগের ১৮টি বিশ্বকাপে কোনো দিন স্বাগতিক দেশ প্রথম রাউন্ডেই ছিটকে পড়েনি। পাহেইরা নিশ্চয়ই তাঁর প্রাক্তন রেকর্ডের উল্টোটা অর্জনে উত্সাহী হবেন না। তবে তাঁর এও মনে রাখতে হবে, ১৮টি বিশ্বকাপে মাত্র ছয়টি আয়োজক দেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
‘বি’ গ্রুপে ম্যারাডোনা-মেসির আর্জেন্টিনার সঙ্গে আছে নাইজেরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া আর গ্রিস। এখানে একমাত্র প্রশ্ন শেষ ষোলোর রাউন্ডে আর্জেন্টিনার সঙ্গী কে হবে? দক্ষিণ কোরিয়া আর গ্রিসের প্রতি অসম্মান না করেও বলা যায়, নিজ মহাদেশে নাইজেরিয়া দর্শক সমর্থনে উজ্জীবিত হয়ে সম্ভবত পরের রাউন্ডে যাবে। চেলসির মিকেল নাইজেরিয়ার সেরা খেলোয়াড়। চোটের কারণে তিনি বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়েছেন। তবে আছেন পোর্টসমাউথের কানু, এভারটনের ইয়াকুবু, ইংলিশ ও ফরাসি লিগের বিভিন্ন ক্লাবের সক্ষম ও শক্ত সব তারকা।
গ্রুপ ‘সি’তে আগে উল্লিখিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ইংল্যান্ডের ১৯৫০ সেই বিস্ময়কর ফলাফলের পরে মার্কিনরা অনেক এগিয়েছে। আজ অনেক মার্কিন প্রিমিয়ার লীগসহ ইউরোপীয় বিভিন্ন লীগের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। ইতিমধ্যেই বুকিরা এই খেলাকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেছেন। এর সম্ভাব্য ফল নিয়েও নানা ধরনের জল্পনাকল্পনা শুরু হয়েছে। যেকোনো ফল আসতে পারে এ খেলা থেকে। সম্ভাব্য বিজয়ী ইংল্যান্ডকে সামনে এগোতে হলে এই খেলা ভালোভাবে পার হতে হবে। ল্যানডন ডনোভান (প্রাক্তন এভারটন এবং এখন ডেভিড বেকহামের এলএ গ্যালাক্সি সতীর্থ) এবং ইলিশ, ইতালিয়ান ও জার্মান লিগের বিভিন্ন ক্লাবে ছড়িয়ে থাকা খেলোয়াড়-ভরা মার্কিন দল আগের মতো উপেক্ষণীয় নয় যে এখন খেলায় জিতলে সেই ফলাফল আবার যাচাই হবে, সে অবস্থা নেই। এবং সন্দেহ নেই আলজেরিয়া আর স্লোভেনিয়াকে ডিঙিয়ে ১৬-এর রাউন্ডে ইংল্যান্ডের সঙ্গী হওয়ার সম্ভাবনা তাদেরই বেশি।
গ্রুপ ‘ডি’তে শীর্ষ বাছাই জার্মানির সঙ্গে কে যাবে? সে লড়াইটা জমবে ভালো অস্ট্রেলিয়া, সার্বিয়া আর ঘানার মধ্যে। এ তিন দলের যেকোনো দুটি শক্তিসম্পন্ন ১৬-এর রাউন্ডে যাওয়ার। ঘানা খেলতে আসছে সেরা খেলোয়াড় মাইকেল এসিয়েনকে ছাড়াই। এর পরও ইউরোপের বিভিন্ন লিগ থেকে আগত খেলোয়াড় নিয়ে গড়া ঘানা শারীরিক যোগ্যতায় নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন আর আইভরিকোস্টের মতোই উঁচু মানের। অস্ট্রেলিয়া আর সার্বিয়ারও আছে ইউরোপীয় লিগের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন খেলোয়াড়।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ভিদিচ সার্বদের সেরা সঞ্চয়। ইন্টার মিলানের স্ট্যানকোভিচ আর ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবের খেলোয়াড় আছেন সার্বিয়ায়। কাগজে-কলমে গ্রুপের দ্বিতীয় সেরা দল। এমনকি শুভ দিনে জার্মানদের ধরে ফেলার মতো দল সার্বিয়া। অস্ট্রেলিয়ারও আছে ইউরোপের বিভিন্ন লিগের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন খেলোয়াড়। এবং এর পরও ঘানা নিজ মহাদেশের দর্শকদের সমর্থনে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য খুবই ভয়ংকর প্রতিপক্ষ।
গ্রুপ ‘ই’তে হল্যান্ডের সঙ্গে আছে ডেনমার্ক, জাপান আর ক্যামেরুন। এক প্রতাপান্বিত বাছাইপর্ব শেষ করেন এসেছে হল্যান্ড। শুরুতেই যা বলেছি, তার রেশ ধরে আবার বলছি, ডাচরা গ্রুপ ‘ই’-এর শীর্ষ দল হিসেবে পরের রাউন্ডে গেলে পরবর্তী স্থানের সবচেয়ে বড় দাবিদার ক্যামেরুন। স্যামুয়েল ইতো আর বিভিন্ন ইউরোপীয় ক্লাবের খেলোয়াড় নিয়ে ক্যামেরুন ১৬-এর রাউন্ডের জন্য ডেনমার্ক আর জাপানের ঘাম ঝরাবে। ডেনমার্ক ইউরোপের শক্ত দল। অন্যদিকে ৩০ মে, ২০১০ গা গরমের খেলায় ইংল্যান্ডকে প্রায় রুখে দিয়েছিল জাপান।
বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ইতালি মজায় আছে ‘এফ’ গ্রুপে প্যারাগুয়ে, নিউজিল্যান্ড ও স্লোভাকিয়াকে নিয়ে। একমাত্র প্যারাগুয়ে বাদে নিউজিল্যান্ড ও স্লোভাকিয়ার কাছ থেকে তাদের বেগ পাওয়ার কথা নয়। ইতালির সমস্যা হলো তারা শুরু করে অত্যন্ত সাদামাটাভাবে। তবে অতীত ইতিহাস যা দেখিয়েছে, একবার ইতালি গ্রুপ পর্যায়ের বাইরে যেতে পারলে তার যাত্রা শেষ হয় প্রায় শেষ পর্যায়ে যেয়ে। অন্য দলগুলোর সমস্যা হবে। এবং ইতালির নিজেরও হবে। যদি কোনোভাবে ইতালি দু-একটা ড্র-এর মধ্য দিয়ে গিয়ে গ্রুপের প্রথম স্থানটা হারায়। পরের রাউন্ডেই দেখা হয়ে যাবে সম্ভবত ‘ই’ গ্রুপজয়ী হল্যান্ডের সঙ্গে এবং তা পেরোলে কোয়ার্টার ফাইনালে ‘জি’ গ্রুপের সম্ভাব্য জয়ী ব্রাজিলের সঙ্গে। এ ধরনের ত্বরিত সাক্ষাতের চিন্তা নেই ফিফার তৈরি সিডিং আর ফরম্যাটে। ধরে নিই ইতালি তার গ্রুপ জিতেছে। সে ক্ষেত্রে তার সাথী হবে কে? খুব সম্ভব ম্যানচেস্টার সিটির রকি সান্তা ক্রুজের দল প্যারাগুয়ে, যদি না নিউজিল্যান্ড ও স্লোভাকিয়া হঠাৎ ঝলসে ওঠে।
‘জি’ গ্রুপকে নাম দেওয়া হয়েছে ‘গ্রুপ অব ডেথ’। শীর্ষ বাছাই ব্রাজিল বাদে এই গ্রুপের অন্য তিন দল উত্তর কোরিয়া, আইভরিকোস্ট আর পর্তুগাল। যদি ধরে নেওয়া হয় এশিয়ার প্রতিনিধি গ্রুপের সবচেয়ে দুর্বল দল, তাহলে দ্বিতীয় স্থানটির জন্য লড়াই ভালোই জমবে আইভরিকোস্ট আর পর্তুগালের মধ্যে। এবং এ ধারণা নিছক অযৌক্তিক নয় যে দিদিয়ের দ্রগবা, সলোমান কালু, কোলো তোরে, ইমানুয়েল এবু (সবাই ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের), ইয়াইয়া তোরে (বার্সেলোনা) প্রমুখ নিজ মহাদেশে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো-নানি-পেপে-পাওলো ফেরেরা-রিকার্ডো কারভালহো-ডেকোর পর্তুগালকে ভালোই ধরবে দ্বিতীয় স্থানটির জন্য। এবং এ দ্বৈরথে আইভরিকোস্টের এগিয়ে যাওয়া মোটেই বিস্ময়কর হবে না।
গ্রুপ ‘এইচ’ স্পেনের গ্রুপ। সঙ্গে আছে সুইজারল্যান্ড, হন্ডুরাস আর চিলি। স্পেনের জন্য যেখানে অনেকেই প্রতিযোগিতার শীর্ষস্থানটি নির্ধারণ করে রেখেছে, সেখানে গ্রুপ জেতা তো তাদের জন্য কোনো রকম প্রশ্নই আনবে না। ইনিয়েস্তা, ফ্যাব্রিগাস, আলোনসো আর জাভির সমন্বয়ে গড়া মাঝমাঠের সামনে তোরেস আর ভিয়ার মতো ফরোয়ার্ড থাকলে সেই দলের আর কী চিন্তা থাকতে পারে! স্পেনের সঙ্গী হবে কে? হন্ডুরাসকে বাদ রেখে চিলি-সুইজারল্যান্ডের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব জমবে সন্দেহ নেই। দু দেশেরই ইউরোপের বিভিন্ন লিগে খেলা অভিজ্ঞতার সমাহার। ইউরোপের মাটিতে হলে চোখ বন্ধ করে বলা যেত সুইজারল্যান্ড যাবে পরের রাউন্ডে। নিরপেক্ষ ভেন্যু বলেই বলা যায় না কোন দল পরের পর্যায়ে যাচ্ছে।
কল্পনার জগতে বিভিন্ন কম্বিনেশন আসতে পারে। তা থেকে ১৬-এর রাউন্ডের দলগুলোকে এভাবে সাজানো যেতে পারে—ফ্রান্স বনাম নাইজেরিয়া, ইংল্যান্ড বনাম ঘানা, হল্যান্ড বনাম প্যারাগুয়ে, ব্রাজিল বনাম চিলি—এই চারটি খেলা থেকে এক ফাইনালিস্ট। আর এর বিপরীতে আর্জেন্টিনা বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা, জার্মানি বনাম যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি বনাম ক্যামেরুন এবং স্পেন বনাম আইভরিকোস্ট—এই চারটি খেলা থেকে আরেক ফাইনালিস্ট।
কোয়ার্টার ফাইনালের লাইনআপ? যদি আমরা ফিফার চিন্তাই অনুসরণ করি তাহলে ফ্রান্স বনাম ইংল্যান্ড, হল্যান্ড বনাম ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা বনাম জার্মানি এবং ইতালি বনাম স্পেন। সেমিফাইনাল? ইংল্যান্ড বনাম ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা বনাম স্পেন। ফাইনাল ব্রাজিল বনাম স্পেন। জয়ী ব্রাজিল বা স্পেন।
অথবা হয়তো পুরো হিসাবটাই ভুল। হয়তো কোনো আফ্রিকান দল—দক্ষিণ আফ্রিকা বা আইভরিকোস্ট অথবা ক্যামেরুন বা ঘানা—ফাইনাল খেলবে ব্রাজিলের সঙ্গে।
ফুটবল বড় নিষ্ঠুর খেলা। যেভাবে স্বপ্ন দেখা হয়, ঠিক সেভাবে সব চলে না। সেরা দল অনেক সময়ই চ্যাম্পিয়ন হয় না। এ বছর স্পেন বা দুনিয়ার সেরা খেলোয়াড় মেসির ক্ষেত্রে এটা মনে রাখতে হবে। ১৯৩৮ সালে ব্রাজিল সেরা খেলোয়াড় লিওনিডাসকে বসিয়ে রেখে সেমিফাইনালে ইতালিকে রুখতে যায়; তাদের সেই প্রয়াস সফল হয়নি। ১৯৫০ সালে ব্রাজিল আবার আটকা পড়ে। সেরা দল নিয়ে মারাকানা স্টেডিয়ামে নির্ধারণী খেলায় নিজ সমর্থকদের সামনে উরুগুয়ের বিরুদ্ধে এক গোলে এগিয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ১-২ গোলে হার মানে। ১৯৫৪ সালে সম্ভবত সবচেয়ে বড় বিস্ময়ের জন্ম দেয় হাঙ্গেরি ফাইনালে জার্মানদের বিরুদ্ধে কাপ না জিতে (অবশ্য সে খেলায় রেফারির জার্মানপন্থী ভূমিকাও অনেকাংশে ফলাফলের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়)। ১৯৭৪ সালে সাম্প্রতিক কালের সেরা দল ক্রুইফ-নিসকিন্সের হল্যান্ড ‘টোটাল ফুটবল’ খেলে অল্পের জন্য শিরোপাবঞ্চিত থাকে। ১৯৯০ সালেই কি আর্জেন্টিনার প্রাপ্য ছিল না বিশ্বকাপ? এর উত্তর অবশ্য ভালো দিতে পারবেন ওই খেলার মেক্সিকান রেফারি কোদেসাল। দক্ষিণ আফ্রিকার আবহাওয়া ইউরোপীয় দলগুলোকে সাহায্য করবে, কিন্তু মনে রাখা দরকার ইউরোপীয়রা কোনো দিন নিজ মহাদেশের বাইরে কাপ জেতেনি। আর ব্রাজিলই একমাত্র দল, যারা নিজ মহাদেশের বাইরেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
যে ২৯ জন রেফারি এবার বিশ্বকাপের ৩১ দিনব্যাপী ৬৪টি খেলা পরিচালনা করবেন, তাঁদের ভুল-ভ্রান্তির ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করবে। তেমনি নির্ভর করবে কোনো এক অজানা তারকার হঠাৎ প্রকাশের মধ্য দিয়ে, কিংবা কোনো রক্ষণভাগের মুহূর্তের ভুলে। পুরো খেলা নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিপক্ষের এক আক্রমণে হঠাৎ এক গোল এবং তাতেই সমাপ্তি স্বপ্নের।
১১ জুলাই জোহানেসবার্গের সকার সিটির নব্বই হাজার দর্শক এবং দুনিয়া-জোড়া টিভি সেটের সামনে বসা কয়েক শ কোটি ফুটবলাসক্ত মানুষের সাক্ষাতে হবে সে স্বপ্নপূরণ বা স্বপ্নভঙ্গের শেষ অধ্যায়। তদাবধি অধীর উত্তেজনার অপেক্ষা।
আখতার হোসেন খান তারিখ: ১১-০৬-২০১০
বিশ্বকাপ হাতে পেলে-বেকেনবাওয়ার-ম্যারাডোনা-জিদান। এবার কার হাতে ট্রফি?
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে এই বিশেষ সংখ্যাটি যখন আপনার হাতে পৌঁছেছে, তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আফ্রিকা মহাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। আজকের দিনে বিশ্বকাপ আক্ষরিক অর্থেই ‘গ্রেটেস্ট শো অন দ্য আর্থ’। কোটি কোটি টাকার আয়োজন, অপরিসীম আনন্দ আর কোটি কোটি টাকার ব্যবসা।
একসময় এই বিশ্বকাপের নিমন্ত্রণ ফিরিয়ে দেওয়ার মতো সাহস দেখাত দলগুলো। আদিতে ১৬ দলের বিশ্বজোড়া প্রতিযোগিতা আজ পরিণত হয়েছে ৩২ দলের বর্ধিত মনকাড়া, হূদয়হারা এমন এক যুবযুদ্ধে, যা থেকে কোনোক্রমেই আর দূরে থাকা সম্ভব নয়।
সারা দুনিয়ায় খেলোয়াড় সরবরাহকারী আফ্রিকা ২০০৬-এর বিশ্বকাপ অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পেতে পেতে পায়নি। ২০১০ তাই কালো মহাদেশের স্বপ্নপূরণের বছর। সেই স্বপ্নের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে তাদের সেরা তারকা দ্রগবা-এসিয়েন-ইতোদের বিশ্বকাপ-জয়ের স্বপ্ন। এই স্বপ্ন আফ্রিকা মহাদেশ বহন করবে আগামী এক মাস।
দক্ষিণ আফ্রিকার নয়টি শহরের দশটি স্টেডিয়ামে ৩১ দিনব্যাপী এই প্রতিযোগিতার ৬৪টি খেলা নির্ধারণ করবে পরের চার বছরের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। আফ্রিকা মহাদেশে বিশ্বকাপ এই প্রথম, এই নিয়ে ‘কালো’ মহাদেশে এক দারুণ উদ্দীপনা। ‘জনগণের খেলা’ বা ‘সুন্দর খেলা’ নামধারী ফুটবলের নবজাগ্রত শক্তি আফ্রিকায় তাই আয়োজনেই নয়, জয়ের স্বপ্নেও সবাই বিভোর। দক্ষিণ আফ্রিকা, আইভরিকোস্ট, ঘানা বা নাইজেরিয়া যেকোনো অঘটন ঘটাতে সক্ষম।
ইউরোপিয়ান লিগের ক্লাবগুলোতেই শুধু নয়, জাতীয় দলগুলোতেও ক্রমাগত বাড়ছে আফ্রিকা থেকে আগত অভিবাসী খেলোয়াড়ের সংখ্যা। গায়ে-গতরে বা দক্ষতায় তাঁরা স্থানীয়দের সঙ্গে সমানভাবে পাল্লা দেন। আইভরিকোস্টের দিদিয়ের দ্রগবার মতো কজন আছেন পুরো ইউরোপে? ঘানার দুঃখ, দলীয় প্রশিক্ষক-বর্ণিত ‘অন্য গ্রহের খেলোয়াড়’ মাইকেল এসিয়েনকে ছাড়াই তারা আসছে বিশ্বকাপে।
তথাপি ফর্মের হিসাবে চিরন্তন ব্রাজিল এখনো এগিয়ে ফিফা বা বাজিকরদের খাতায়। ২০০২-এর রোনালদো, রিভালদো বা রোনালদিনহোর মতো কেউ নেই এই দলে। কাকার শারীরিক অবস্থা প্রশ্নবিদ্ধ, লুইস ফ্যাবিয়ানো আর নিলমার ২০০৮ সালে কনফেডারেশনস কাপে অনেক গোল করার পরও মেসি-ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো, তোরেস বা দ্রগবার মতো নন। তবু ব্রাজিলের আছে শক্ত রক্ষণভাগ; অত্যন্ত উঁচু মানের গোলরক্ষক আর আছে পাঁচবার বিশ্বকাপ জেতা এবং সবগুলো বিশ্বকাপে খেলার অনন্য ঐতিহ্য।
সম্ভাব্য বিজয়ীদের খাতায় প্রথম কাতারে আরও আছে ২০০৮ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়ন স্পেন। ইনিয়েস্তা, জাভি আর আলোনসোর সমন্বয়ে গড়া মাঝমাঠের সামনে ফরোয়ার্ড হিসেবে তোরেস-ভিয়ার উপস্থিতি যেকোনো রক্ষণভাগের জন্য ত্রাস। আছে ওয়েইন রুনি, রিও ফার্ডিনান্ড, ফ্রাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের ইংল্যান্ড; শিরোপাধারী ইতালি, নতুন বলে বলীয়ান হল্যান্ড; আর সব সময় যাদের হিসাবের মধ্যে রাখতে হয়, সেই জার্মানি।
লিওনেল মেসির আর্জেন্টিনা তো অবশ্যই আসবে বিবেচনায়। মেসি অনেকেরই বিবেচনায় দুনিয়ার সেরা খেলোয়াড়। অনেকেরই আবার ধারণা, এ মুহূর্তে ছিয়াশির ম্যারাডোনা নন, ১৯৮২-এর ম্যারাডোনার পর্যায়ে আছেন তিনি। আর্জেন্টিনার পক্ষে মেসির এখন পর্যন্ত অর্জন তাঁর বার্সেলোনার অর্জনের ধারে-কাছে যায়নি। তবু সন্দেহ নেই, সারা দুনিয়ার চোখ থাকবে তাঁর দিকে। প্রায় কাছাকাছি বয়সের ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো বা ওয়েইন রুনি আর ফার্নান্দো তোরেস কিংবা দিদিয়ের দ্রগবা কোনো বিচারেই কম নন, কিন্তু সবার নজর ওই আর্জেন্টাইনের দিকেই: তাঁকে ধরা হচ্ছে বর্তমান যুগের ম্যারাডোনা ।
ইতিহাসের দিকে তাকানো যাক। গত আঠারোটি কাপ জিতেছে সাতটি দেশ: ব্রাজিল (৫ বার), ইতালি (৪), জার্মানি (৩), উরুগুয়ে (২), আর্জেন্টিনা (২), ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স একবার করে। ১৯৫০ পর্যন্ত চারটি বিশ্বকাপের ভাগাভাগি হয় উরুগুয়ে (প্রথম ও চতুর্থটি) ও ইতালির মধ্যে। ১৯৫৪তে জার্মানি যুক্ত হয় তালিকাতে, ১৯৫৮তে ব্রাজিল, ১৯৬৬তে ইংল্যান্ড, ১৯৭৮-এ আর্জেন্টিনা আর ১৯৯৮-এ ফ্রান্স। ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা আর ফ্রান্সের তালিকাভুক্তির বছরটি নিয়ে একটা গাণিতিক সূত্রও বের করা যেতে পারে: দশকের অষ্টম বছরে একটি আরেকটির চেয়ে বিশ বছর পরে পরে।
১৯৯৮ সাল থেকে কায়েম হওয়া সাত দেশের ‘ক্লাব’ এবার আটে উত্তীর্ণ হওয়ার দ্বারপ্রান্তে: স্পেন স্মরণকালের সেরা দল নিয়ে হাজির হয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, আর্সেনাল আর লিভারপুলের তারকাদের পদচারণে মুখর স্পেনের জাতীয় দল। তোরেস, ফ্যাব্রিগাস, ইনিয়েস্তা, ক্যাসিয়াস, আলোনসো, জাভি প্রমুখে সমৃদ্ধ ২০০৮-এর ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন স্পেন এবার বাছাইয়ের অবস্থানে চিরন্তন শীর্ষ বাছাই ব্রাজিলের সমানে সমান। গত ডিসেম্বরে ড্রর দিনই তাই এক স্বাপ্নিক তো লিখেই ফেললেন, ফাইনাল হবে ব্রাজিল ও স্পেনের, আর সে ফাইনাল টাইব্রেকারে গড়াবে। ফুটবলের অপূর্ণ অতি সম্ভাবনার দেশ স্পেন: যে দেশের ফুটবলের মান নির্ধারিত হয় রিয়াল মাদ্রিদ আর বার্সেলোনার মতো ক্লাব দ্বারা, তাদের অনেক আগেই বিশ্বকাপ জেতা উচিত ছিল।
স্পেনের অল্প পেছনেই আছে হল্যান্ড: দুবার বিশ্বকাপের ফাইনাল খেলা ডাচরা সত্তরের দশকের মতো ক্রুইফ, নিসকেন্স, রেপ, আরি হান পর্যায়ের খেলোয়াড় আর ‘টোটাল ফুটবল’ নিয়ে গর্ব করতে না পারলেও বাছাইপর্বে তাদের খেলা ছিল স্পেন আর ইংল্যান্ডের মতোই তুখোড় আর সম্ভাব্য বিজয়ীর মতোই। ইউরোপের সেরা দলগুলোর মতোই ডাচরাও যেকোনো উচ্চতায় উঠতে সক্ষম: ১৯৭৪ সালে তাদের বিশ্বকাপ জেতা যুক্তিসংগত ছিল। কেন পারেনি, তা আজ ইতিহাসের গবেষণার বিষয়, কিন্তু ১৯৭৮ সালেও যে দল নিয়ে ওরা শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তাই বা কম কিসে। আজকের ডাচ দলে ইন্টার মিলানের স্নাইডার, বায়ার্ন মিউনিখের আরিয়েন রোবেন, লিভারপুলের ডার্ক কিউট, রিয়াল মাদ্রিদের রাফায়েল ফন ডার ভার্ট আর আর্সেনালের ফন পার্সির মতো খেলোয়াড়েরা বিশ্বের যেকোনো দলে জায়গা করে নেওয়ার মতো তারকা।
ইউরোপ থেকে আসা আরেক শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ড। পৃথিবীর অন্যতম সেরা ফরোয়ার্ড রুনির ওপরই ভর করে নেই তারা; জেরার্ড, ল্যাম্পার্ড, টেরির মতো খেলোয়াড়েরাও আছেন ইংল্যান্ড দলে। ‘সি’ গ্রুপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, আলজেরিয়া আর স্লোভেনিয়ার সঙ্গে খেলে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হবে ইংল্যান্ড, সবার তা-ই প্রত্যাশা। ইংল্যান্ডকে অবশ্য ১২ জুন রাস্টেনবার্গের রয়াল বাফোকেং স্টেডিয়ামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাধা পেরোতে হবে। তারা অবশ্যই ১৯৫০ সালে ব্রাজিলে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্বকাপে মার্কিনদের হাতে অপদস্থ হওয়াটাও মনে রাখবে। ইংল্যান্ডের বিজয় এতই অনিবার্য ধরা হচ্ছিল যে যখন পত্রিকা অফিসে প্রথম ওই ১-০ মার্কিন বিজয়ের খবর যায়, অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন, ফলাফলটা ইংল্যান্ডের পক্ষে ১০-১ হয়েছে। বেলো হরিজেন্তের ওই আপসেট বিশ্বকাপ-গাথার অংশ হয়ে আছে।
গ্রুপে প্রথম না হতে পারলে ইংল্যান্ডকে ১৬-এর রাউন্ডেই ‘ডি’ গ্রুপের সম্ভাব্য শীর্ষ দল জার্মানির মুখোমুখি হতে হবে। এবং সন্দেহ নেই, সেটা কোনো সুখকর জিনিস নয়।
ইতালিসহ জার্মানি বিশ্বকাপে সচরাচর সম্ভাবনার প্রথম কাতারের দল। জার্মানি ব্রাজিলের মতোই সাতটি ফাইনাল খেলেছে। ইতালি বর্তমানের চ্যাম্পিয়ন। দুটি দেশই ইউরোপের বিভিন্ন লিগে খেলা অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ে ভরা। কে জানত ১৯৮২তে ব্রাজিলকে টপকে ইতালি ফাইনাল খেলবে। তেমন উল্লেখ্য দল ছিল না ১৯৮২, ১৯৮৬ বা ২০০২ সালে, কিন্তু তাই নিয়ে জার্মানি যে ফাইনালে যাবে, তা-ই বা কোন হিসাবে ছিল। একই কথা ইতালিকে নিয়ে। সারা দুনিয়া যখন ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা বা অন্য কাউকে নিয়ে হইচই করে, ইতালি বা জার্মানি সিঁধেল চোরের মতো সন্তর্পণে এসে সেমিফাইনালে বা ফাইনালে ঢোকে কিংবা শিরোপাও জিতে নেয়।
ফুটবলে সাম্প্রতিক কালে এক বিপ্লব ঘটেছে। এটা মূলত ইউরোপ-ভিত্তিক (ক্রিকেটে যা হয়েছে ভারতে)। গত বিশ বছরে ইউরোপের বড় ক্লাবগুলোর চাহিদার প্রয়োজনে সারা দুনিয়া বিশেষত দক্ষিণ, মধ্য ও উত্তর আমেরিকা এবং আফ্রিকা থেকে খেলোয়াড় এসে বোঝাই হচ্ছেন ইউরোপে। অস্ট্রেলিয়াও বাদ নেই এই সরবরাহ-কর্ম থেকে। বিশেষত আফ্রিকার দারিদ্র্য এবং একই সঙ্গে এর যুবশক্তির দৈহিক যোগ্যতা ও ফুটবল-দক্ষতা ঝাঁকে ঝাঁকে আফ্রিকানকে ইউরোপে টেনেছে। অনেকেই অভিবাসী হয়েছেন এবং অভিবাসী না হয়েও অন্যান্য মহাদেশেও তাঁরা খেলছেন। অনেকে কৌশল ও মানের বলে নিজ জাতীয়তা বজায় রেখেই সারা দুনিয়ায় সগর্বে খেলে বেড়াচ্ছেন। দ্রগবা, এসিয়েন, ইতো এঁদেরই অন্যতম। যাঁরা অভিবাসী, তাঁরাও জাতীয় দলে জায়গা করে নিচ্ছেন। জিদানের কথা বাদই গেল; পর্তুগাল বাদে বিশ বছর আগে ইউরোপের কোনো জাতীয় দলে কালো খেলোয়াড় পাওয়া দুষ্কর ছিল। সেই চিত্র আজ অনেক পাল্টে গেছে। টেলিভিশন-বিজ্ঞাপনের টাকার টানে আর বিদেশি বিনিয়োগে ইংল্যান্ড, ইতালি, জার্মানি আর স্পেন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ক্লাবগুলোর আখড়া।
এরই একটা ফল হলো এসব দেশ থেকে খুব কম ভালো খেলোয়াড় বাইরে যান। এবারের বিশ্বকাপে স্পেনের ২৩ জনের মধ্যে মাত্র তিনজন বাইরে খেলেন; লিভারপুলের তোরেস ও রেইনা আর আর্সেনালের সেস ফ্যাব্রিগাস। চোখে পড়ার মতো উল্লেখ্য বিষয় হলো, তিনটি দল পুরোপুরি স্বদেশি ক্লাবের খেলোয়াড়ে তৈরি—ইংল্যান্ড, ইতালি আর জার্মানি। পয়লা জুন রাতে ফিফার প্রকাশিত প্রতিটি জাতীয় দলের ২৩ জন খেলোয়াড়ের তালিকায় দেখা যায় এমনকি উত্তর কোরিয়ারও তিনজন খেলোয়াড় (হং ইয়ং-জো, আন ইয়ং-হাক ও জং তা-সে) বিদেশি ক্লাবে (প্রথম জন রাশিয়ায় আর অন্য দুজন জাপানে) খেলেন। ইংল্যান্ড, ইতালি আর জার্মানি সম্ভবত পশ্চিমা দুনিয়ার ফুটবল-বিপ্লবের প্রতীক, তেমনি এর সহজাত জনসংখ্যা-ঘাটতির বোঝা সবচেয়ে বেশি বহন করে চলছে।
আটটি গ্রুপের দলগুলোকে ফিফার সিডিং-ভিত্তি মোটামুটি মাথায় রেখে কাপ-যুদ্ধের একটা আনুমানিক দৃশ্য আঁকা যায় আগামী এক মাসের জন্য। ‘এ’ গ্রুপে দক্ষিণ আফ্রিকা, মেক্সিকো, উরুগুয়ে বা ফ্রান্স ‘জি’ গ্রুপের মতোই, যদিবা একটু কম শক্তিমত্তার, আরেক ‘গ্রুপ অব ডেথ’। দুবার বিশ্বকাপজয়ী উরুগুয়ে ১৯৭০-এর পরে আর সেমিফাইনালেও যায়নি। ফ্রান্স ২০০৬-এর রানার্স-আপ এবং থিয়েরি অঁরির হ্যান্ডবল গোলে চূড়ান্ত পর্বে এলেও ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, রিয়াল মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, চেলসি, আর্সেনাল, বায়ার্ন মিউনিখ আর সেরা ফরাসি ক্লাবগুলোর খেলোয়াড় নিয়ে গড়া ফরাসি দলকে যতটা সম্ভাবনা থেকে দূরে ভাবা হয়, কার্যত তা নয়। প্যাট্রিস এভরা, ফ্রাঙ্ক রিবেরি আর নিকোলাস আনেলকা বিশ্বখ্যাত।
দক্ষিণ আফ্রিকা তার পুরো মহাদেশের চ্যালেঞ্জের নেতৃত্ব দেবে (অন্যদের মধ্যে থাকবে ‘জি’ গ্রুপের আইভরিকোস্ট, ‘বি’ গ্রুপের নাইজেরিয়া আর ‘ডি’ গ্রুপের ঘানা)। শেষ মুহূর্তে এসে সর্বোচ্চ গোলদাতা ম্যাকার্থি বাদ পড়েছেন চূড়ান্ত ২৩ থেকে, তবে আছেন স্টিভ পিয়েনার। স্বাগতিক দেশ হওয়ার যে সুবিধা দক্ষিণ আফ্রিকার আছে, বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিলীয় কোচ কার্লোস আলবার্তো পাহেইরার প্রশিক্ষণে তা পিয়েনাররা কতটুকু সামনে নিয়ে যাবেন, তার জন্য অধীর হয়ে আছেন স্বাগতিক দেশের লক্ষ-কোটি সমর্থক।
ধরে নেওয়া যেতে পারে, ১৬-এর রাউন্ডের জন্য ফ্রান্সই থাকবে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে। উরুগুয়ে বা মেক্সিকোর বিপক্ষে তেমন কিছু বলার যেমন নেই, তেমনি পক্ষেও খুব বলার নেই। ডিয়েগো ফোরলান উরুগুয়ের সেরা খেলোয়াড়; অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের পক্ষে এবার তিনি এক সাফল্যময় মৌসুম পেরিয়ে এসেছেন; সে উচ্চতা তিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের পক্ষেও পাননি। আরও আছেন ইউরোপীয় ও অন্যান্য লীগের খেলোয়াড়। এর পরও বলা যায়, ফ্রান্স ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে ডিঙিয়ে মেক্সিকো-উরুগুয়ের পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়া দুষ্কর। তা ছাড়া আগের ১৮টি বিশ্বকাপে কোনো দিন স্বাগতিক দেশ প্রথম রাউন্ডেই ছিটকে পড়েনি। পাহেইরা নিশ্চয়ই তাঁর প্রাক্তন রেকর্ডের উল্টোটা অর্জনে উত্সাহী হবেন না। তবে তাঁর এও মনে রাখতে হবে, ১৮টি বিশ্বকাপে মাত্র ছয়টি আয়োজক দেশ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
‘বি’ গ্রুপে ম্যারাডোনা-মেসির আর্জেন্টিনার সঙ্গে আছে নাইজেরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া আর গ্রিস। এখানে একমাত্র প্রশ্ন শেষ ষোলোর রাউন্ডে আর্জেন্টিনার সঙ্গী কে হবে? দক্ষিণ কোরিয়া আর গ্রিসের প্রতি অসম্মান না করেও বলা যায়, নিজ মহাদেশে নাইজেরিয়া দর্শক সমর্থনে উজ্জীবিত হয়ে সম্ভবত পরের রাউন্ডে যাবে। চেলসির মিকেল নাইজেরিয়ার সেরা খেলোয়াড়। চোটের কারণে তিনি বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পড়েছেন। তবে আছেন পোর্টসমাউথের কানু, এভারটনের ইয়াকুবু, ইংলিশ ও ফরাসি লিগের বিভিন্ন ক্লাবের সক্ষম ও শক্ত সব তারকা।
গ্রুপ ‘সি’তে আগে উল্লিখিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ইংল্যান্ডের ১৯৫০ সেই বিস্ময়কর ফলাফলের পরে মার্কিনরা অনেক এগিয়েছে। আজ অনেক মার্কিন প্রিমিয়ার লীগসহ ইউরোপীয় বিভিন্ন লীগের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন। ইতিমধ্যেই বুকিরা এই খেলাকে বেশ গুরুত্ব দেওয়া শুরু করেছেন। এর সম্ভাব্য ফল নিয়েও নানা ধরনের জল্পনাকল্পনা শুরু হয়েছে। যেকোনো ফল আসতে পারে এ খেলা থেকে। সম্ভাব্য বিজয়ী ইংল্যান্ডকে সামনে এগোতে হলে এই খেলা ভালোভাবে পার হতে হবে। ল্যানডন ডনোভান (প্রাক্তন এভারটন এবং এখন ডেভিড বেকহামের এলএ গ্যালাক্সি সতীর্থ) এবং ইলিশ, ইতালিয়ান ও জার্মান লিগের বিভিন্ন ক্লাবে ছড়িয়ে থাকা খেলোয়াড়-ভরা মার্কিন দল আগের মতো উপেক্ষণীয় নয় যে এখন খেলায় জিতলে সেই ফলাফল আবার যাচাই হবে, সে অবস্থা নেই। এবং সন্দেহ নেই আলজেরিয়া আর স্লোভেনিয়াকে ডিঙিয়ে ১৬-এর রাউন্ডে ইংল্যান্ডের সঙ্গী হওয়ার সম্ভাবনা তাদেরই বেশি।
গ্রুপ ‘ডি’তে শীর্ষ বাছাই জার্মানির সঙ্গে কে যাবে? সে লড়াইটা জমবে ভালো অস্ট্রেলিয়া, সার্বিয়া আর ঘানার মধ্যে। এ তিন দলের যেকোনো দুটি শক্তিসম্পন্ন ১৬-এর রাউন্ডে যাওয়ার। ঘানা খেলতে আসছে সেরা খেলোয়াড় মাইকেল এসিয়েনকে ছাড়াই। এর পরও ইউরোপের বিভিন্ন লিগ থেকে আগত খেলোয়াড় নিয়ে গড়া ঘানা শারীরিক যোগ্যতায় নাইজেরিয়া, ক্যামেরুন আর আইভরিকোস্টের মতোই উঁচু মানের। অস্ট্রেলিয়া আর সার্বিয়ারও আছে ইউরোপীয় লিগের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন খেলোয়াড়।
ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ভিদিচ সার্বদের সেরা সঞ্চয়। ইন্টার মিলানের স্ট্যানকোভিচ আর ইউরোপের বিভিন্ন ক্লাবের খেলোয়াড় আছেন সার্বিয়ায়। কাগজে-কলমে গ্রুপের দ্বিতীয় সেরা দল। এমনকি শুভ দিনে জার্মানদের ধরে ফেলার মতো দল সার্বিয়া। অস্ট্রেলিয়ারও আছে ইউরোপের বিভিন্ন লিগের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন খেলোয়াড়। এবং এর পরও ঘানা নিজ মহাদেশের দর্শকদের সমর্থনে অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের জন্য খুবই ভয়ংকর প্রতিপক্ষ।
গ্রুপ ‘ই’তে হল্যান্ডের সঙ্গে আছে ডেনমার্ক, জাপান আর ক্যামেরুন। এক প্রতাপান্বিত বাছাইপর্ব শেষ করেন এসেছে হল্যান্ড। শুরুতেই যা বলেছি, তার রেশ ধরে আবার বলছি, ডাচরা গ্রুপ ‘ই’-এর শীর্ষ দল হিসেবে পরের রাউন্ডে গেলে পরবর্তী স্থানের সবচেয়ে বড় দাবিদার ক্যামেরুন। স্যামুয়েল ইতো আর বিভিন্ন ইউরোপীয় ক্লাবের খেলোয়াড় নিয়ে ক্যামেরুন ১৬-এর রাউন্ডের জন্য ডেনমার্ক আর জাপানের ঘাম ঝরাবে। ডেনমার্ক ইউরোপের শক্ত দল। অন্যদিকে ৩০ মে, ২০১০ গা গরমের খেলায় ইংল্যান্ডকে প্রায় রুখে দিয়েছিল জাপান।
বর্তমান চ্যাম্পিয়ন ইতালি মজায় আছে ‘এফ’ গ্রুপে প্যারাগুয়ে, নিউজিল্যান্ড ও স্লোভাকিয়াকে নিয়ে। একমাত্র প্যারাগুয়ে বাদে নিউজিল্যান্ড ও স্লোভাকিয়ার কাছ থেকে তাদের বেগ পাওয়ার কথা নয়। ইতালির সমস্যা হলো তারা শুরু করে অত্যন্ত সাদামাটাভাবে। তবে অতীত ইতিহাস যা দেখিয়েছে, একবার ইতালি গ্রুপ পর্যায়ের বাইরে যেতে পারলে তার যাত্রা শেষ হয় প্রায় শেষ পর্যায়ে যেয়ে। অন্য দলগুলোর সমস্যা হবে। এবং ইতালির নিজেরও হবে। যদি কোনোভাবে ইতালি দু-একটা ড্র-এর মধ্য দিয়ে গিয়ে গ্রুপের প্রথম স্থানটা হারায়। পরের রাউন্ডেই দেখা হয়ে যাবে সম্ভবত ‘ই’ গ্রুপজয়ী হল্যান্ডের সঙ্গে এবং তা পেরোলে কোয়ার্টার ফাইনালে ‘জি’ গ্রুপের সম্ভাব্য জয়ী ব্রাজিলের সঙ্গে। এ ধরনের ত্বরিত সাক্ষাতের চিন্তা নেই ফিফার তৈরি সিডিং আর ফরম্যাটে। ধরে নিই ইতালি তার গ্রুপ জিতেছে। সে ক্ষেত্রে তার সাথী হবে কে? খুব সম্ভব ম্যানচেস্টার সিটির রকি সান্তা ক্রুজের দল প্যারাগুয়ে, যদি না নিউজিল্যান্ড ও স্লোভাকিয়া হঠাৎ ঝলসে ওঠে।
‘জি’ গ্রুপকে নাম দেওয়া হয়েছে ‘গ্রুপ অব ডেথ’। শীর্ষ বাছাই ব্রাজিল বাদে এই গ্রুপের অন্য তিন দল উত্তর কোরিয়া, আইভরিকোস্ট আর পর্তুগাল। যদি ধরে নেওয়া হয় এশিয়ার প্রতিনিধি গ্রুপের সবচেয়ে দুর্বল দল, তাহলে দ্বিতীয় স্থানটির জন্য লড়াই ভালোই জমবে আইভরিকোস্ট আর পর্তুগালের মধ্যে। এবং এ ধারণা নিছক অযৌক্তিক নয় যে দিদিয়ের দ্রগবা, সলোমান কালু, কোলো তোরে, ইমানুয়েল এবু (সবাই ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের), ইয়াইয়া তোরে (বার্সেলোনা) প্রমুখ নিজ মহাদেশে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো-নানি-পেপে-পাওলো ফেরেরা-রিকার্ডো কারভালহো-ডেকোর পর্তুগালকে ভালোই ধরবে দ্বিতীয় স্থানটির জন্য। এবং এ দ্বৈরথে আইভরিকোস্টের এগিয়ে যাওয়া মোটেই বিস্ময়কর হবে না।
গ্রুপ ‘এইচ’ স্পেনের গ্রুপ। সঙ্গে আছে সুইজারল্যান্ড, হন্ডুরাস আর চিলি। স্পেনের জন্য যেখানে অনেকেই প্রতিযোগিতার শীর্ষস্থানটি নির্ধারণ করে রেখেছে, সেখানে গ্রুপ জেতা তো তাদের জন্য কোনো রকম প্রশ্নই আনবে না। ইনিয়েস্তা, ফ্যাব্রিগাস, আলোনসো আর জাভির সমন্বয়ে গড়া মাঝমাঠের সামনে তোরেস আর ভিয়ার মতো ফরোয়ার্ড থাকলে সেই দলের আর কী চিন্তা থাকতে পারে! স্পেনের সঙ্গী হবে কে? হন্ডুরাসকে বাদ রেখে চিলি-সুইজারল্যান্ডের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব জমবে সন্দেহ নেই। দু দেশেরই ইউরোপের বিভিন্ন লিগে খেলা অভিজ্ঞতার সমাহার। ইউরোপের মাটিতে হলে চোখ বন্ধ করে বলা যেত সুইজারল্যান্ড যাবে পরের রাউন্ডে। নিরপেক্ষ ভেন্যু বলেই বলা যায় না কোন দল পরের পর্যায়ে যাচ্ছে।
কল্পনার জগতে বিভিন্ন কম্বিনেশন আসতে পারে। তা থেকে ১৬-এর রাউন্ডের দলগুলোকে এভাবে সাজানো যেতে পারে—ফ্রান্স বনাম নাইজেরিয়া, ইংল্যান্ড বনাম ঘানা, হল্যান্ড বনাম প্যারাগুয়ে, ব্রাজিল বনাম চিলি—এই চারটি খেলা থেকে এক ফাইনালিস্ট। আর এর বিপরীতে আর্জেন্টিনা বনাম দক্ষিণ আফ্রিকা, জার্মানি বনাম যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি বনাম ক্যামেরুন এবং স্পেন বনাম আইভরিকোস্ট—এই চারটি খেলা থেকে আরেক ফাইনালিস্ট।
কোয়ার্টার ফাইনালের লাইনআপ? যদি আমরা ফিফার চিন্তাই অনুসরণ করি তাহলে ফ্রান্স বনাম ইংল্যান্ড, হল্যান্ড বনাম ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা বনাম জার্মানি এবং ইতালি বনাম স্পেন। সেমিফাইনাল? ইংল্যান্ড বনাম ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা বনাম স্পেন। ফাইনাল ব্রাজিল বনাম স্পেন। জয়ী ব্রাজিল বা স্পেন।
অথবা হয়তো পুরো হিসাবটাই ভুল। হয়তো কোনো আফ্রিকান দল—দক্ষিণ আফ্রিকা বা আইভরিকোস্ট অথবা ক্যামেরুন বা ঘানা—ফাইনাল খেলবে ব্রাজিলের সঙ্গে।
ফুটবল বড় নিষ্ঠুর খেলা। যেভাবে স্বপ্ন দেখা হয়, ঠিক সেভাবে সব চলে না। সেরা দল অনেক সময়ই চ্যাম্পিয়ন হয় না। এ বছর স্পেন বা দুনিয়ার সেরা খেলোয়াড় মেসির ক্ষেত্রে এটা মনে রাখতে হবে। ১৯৩৮ সালে ব্রাজিল সেরা খেলোয়াড় লিওনিডাসকে বসিয়ে রেখে সেমিফাইনালে ইতালিকে রুখতে যায়; তাদের সেই প্রয়াস সফল হয়নি। ১৯৫০ সালে ব্রাজিল আবার আটকা পড়ে। সেরা দল নিয়ে মারাকানা স্টেডিয়ামে নির্ধারণী খেলায় নিজ সমর্থকদের সামনে উরুগুয়ের বিরুদ্ধে এক গোলে এগিয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত ১-২ গোলে হার মানে। ১৯৫৪ সালে সম্ভবত সবচেয়ে বড় বিস্ময়ের জন্ম দেয় হাঙ্গেরি ফাইনালে জার্মানদের বিরুদ্ধে কাপ না জিতে (অবশ্য সে খেলায় রেফারির জার্মানপন্থী ভূমিকাও অনেকাংশে ফলাফলের জন্য দায়ী বলে মনে করা হয়)। ১৯৭৪ সালে সাম্প্রতিক কালের সেরা দল ক্রুইফ-নিসকিন্সের হল্যান্ড ‘টোটাল ফুটবল’ খেলে অল্পের জন্য শিরোপাবঞ্চিত থাকে। ১৯৯০ সালেই কি আর্জেন্টিনার প্রাপ্য ছিল না বিশ্বকাপ? এর উত্তর অবশ্য ভালো দিতে পারবেন ওই খেলার মেক্সিকান রেফারি কোদেসাল। দক্ষিণ আফ্রিকার আবহাওয়া ইউরোপীয় দলগুলোকে সাহায্য করবে, কিন্তু মনে রাখা দরকার ইউরোপীয়রা কোনো দিন নিজ মহাদেশের বাইরে কাপ জেতেনি। আর ব্রাজিলই একমাত্র দল, যারা নিজ মহাদেশের বাইরেও চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
যে ২৯ জন রেফারি এবার বিশ্বকাপের ৩১ দিনব্যাপী ৬৪টি খেলা পরিচালনা করবেন, তাঁদের ভুল-ভ্রান্তির ওপরও অনেক কিছু নির্ভর করবে। তেমনি নির্ভর করবে কোনো এক অজানা তারকার হঠাৎ প্রকাশের মধ্য দিয়ে, কিংবা কোনো রক্ষণভাগের মুহূর্তের ভুলে। পুরো খেলা নিয়ন্ত্রণ করে প্রতিপক্ষের এক আক্রমণে হঠাৎ এক গোল এবং তাতেই সমাপ্তি স্বপ্নের।
১১ জুলাই জোহানেসবার্গের সকার সিটির নব্বই হাজার দর্শক এবং দুনিয়া-জোড়া টিভি সেটের সামনে বসা কয়েক শ কোটি ফুটবলাসক্ত মানুষের সাক্ষাতে হবে সে স্বপ্নপূরণ বা স্বপ্নভঙ্গের শেষ অধ্যায়। তদাবধি অধীর উত্তেজনার অপেক্ষা।
No comments:
Post a Comment