বড় কাপের ছোট রহস্য
একেকটি সেকেন্ডকে এখন মনে হচ্ছে একটি দীর্ঘ দিন কিংবা রাতের মতো, একটি ঘণ্টাকে দীর্ঘ এক যুগ। দলগুলো চূড়ান্ত লড়াইয়ের মঞ্চে এসে উপস্থিত। আকাশে-বাতাসে মাদল বাজছে। মহাসিন্ধুর ওপার থেকে যেন ভেসে আসছে অন্য ভুবনের আনন্দ। বাংলাদেশের আকাশে উঠে গেছে আর্জেন্টিনা-ব্রাজিলের পতাকা। ছোট, মাঝারি কিংবা পেল্লায় আকারের। শরীর আর ধরে রাখতে পারছে না উত্তেজনার তরঙ্গ। কখন আসবে সেই মুহূর্ত, যখন সত্যি সত্যিই মাঠে নামবে ধরনির সবচেয়ে বড় ফুটবল উত্সব।
মূল রং ফুটবল, সেই রং থেকে ছড়িয়ে পড়ে আলোর বর্ণালি। ফুটবল উত্সবই তো। এখানেই মনে হয় একটা সাধারণ ভুল আমরা করে ফেলি। এটা জগতের সেরা ক্রীড়াযজ্ঞও বটে। পরিসংখ্যান বলছে, এই ক্রীড়াযজ্ঞের দিকে এবার সরাসরি মাঠে গিয়ে কিংবা টেলিভিশনের পর্দা দিয়ে চোখ রাখবে পুরো পৃথিবীর প্রায় ৩০০ কোটি মানুষ। তার মানে প্রায় ৬০০ কোটি চোখ। বিশ্বকাপের বিশালতা বোঝাতে আর কী চাই! না, বিশালতার সূচক আরও আছে। যদি বলেন, আয়োজক দেশের অর্থনীতির মানদণ্ডেও সেটি মাপা যায়। সেটি বছর শেষে দক্ষিণ আফ্রিকার জিডিপির উল্লম্ফন আপনাকে পরিষ্কার করে দেবে। আর খেলার মাঠে যা দৃশ্যমান হবে তা প্রতিযোগিতা। প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। ক্ষুরধার প্রতিদ্বন্দ্বিতা, হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। প্রায় তিন বছর ধরে ২০০টিরও বেশি দেশ পরস্পরের সঙ্গে ৮৫৩টি ম্যাচ খেলে ১১ জুন থেকে শুরু দক্ষিণ আফ্রিকার মূল মঞ্চে দাঁড়ানোর টিকিট মিলেছে ৩১টি দেশের। ব্যতিক্রম দক্ষিণ আফ্রিকা।
আয়োজনের সুবাদে তাদের হাতে টিকিট উঠেছে সরাসরি। তাই দক্ষিণ আফ্রিকাকে বাদ রাখলে ৩২ দলের লড়াইয়ের মঞ্চে বিশ্বসেরা ৩১টি দলকেই পাচ্ছেন। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকাই বেশি পরিষ্কার করে বলছে, প্রতিদ্বন্দ্বিতা কতটা তীব্র মাত্রার। এই প্রথম কোনো দেশ আয়োজক হলো যাদের ফিফা র্যাঙ্কিং পঞ্চাশের নিচে। বলাই বাহুল্য, ফিফার মহাদেশীয় নীতি ছাড়া আফ্রিকার কপালে দক্ষিণ আফ্রিকার ভাগ্যে বিশ্বকাপ জুটত না। নিন্দুকেরা বলে, ফিফার সর্বোচ্চ পদটা আরেকটা মেয়াদের জন্য নিশ্চিত করতেই সেপ ব্ল্যাটার আফ্রিকার ভোটগুলো নিশ্চিত করলেন এই বিশ্বকাপ উপহার দিয়ে।
সে যে যা-ই বলুন, একটা বিশ্বকাপের আয়োজনভার পেতে আফ্রিকার এত সুদীর্ঘ অপেক্ষা করাটাও তো ব্যাখ্যার অতীত। তবে দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য এটি লজ্জার হয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের সবচেয়ে কম ফিফা র্যাঙ্কিং নিয়ে বিশ্বকাপের আয়োজক হওয়া।
এবার তাহলে আরেকটি ইতিহাসও রচিত হতে যাচ্ছে, প্রথম রাউন্ডেই বাদ পড়ছে আয়োজক দেশ! না, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রার্থনায় বসে গেছে, ইতিহাসের পাতায় লজ্জার চকখড়িতে নাম কিছুতেই লেখানো যাবে না। তাই এর আগে যিনি চারটি ভিন্ন দেশকে বিশ্বকাপে নিয়ে গেছেন, ব্রাজিলকে এনে দিয়েছেন চতুর্থ বিশ্বকাপ শিরোপা, সেই ব্রাজিলিয়ান কার্লোস আলবার্তো পাহেইরাকে কোচ করে এনেছে স্বাগতিক দেশ। দ্বিতীয় দফা এসে কাজ করছেন তিনি। আয়োজক হিসেবে দক্ষিণ আফ্রিকার নাম ঘোষিত হওয়ার পরপরই এসেছিলেন এক দফা। পারিবারিক কারণে দেশে ফিরে গিয়েছিলেন মাঝখানে। আবার তাঁকেই ফিরে এসে হাড়িকাঠের নিচে পেতে দিতে হয়েছে মাথা।
হাড়িকাঠ কেন? দক্ষিণ আফ্রিকার কোচ তো থাকবেন নির্ভার, সদানন্দ। ৩২ দেশের মধ্যে সর্বনিম্ন র্যাঙ্কিংয়ের দেশটিকে নিয়ে কেউ তো স্বপ্ন দেখে না। অংশগ্রহণের ‘ব্যারন পিয়েরে দ্য কুবার্তিনীয় মহান নীতি’ই তো গলার মালা হওয়া উচিত তাদের। বাস্তব ক্ষেত্রে মোটেই তা নয়। পাহেইরা রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে লোকেরা কাছে এসে আবদার জানিয়ে যাচ্ছে, ‘কোচ, বিশ্বকাপটা আমাদের এনে দিতে হবে।’
নেলসন ম্যান্ডেলার কথাই ধরুন। বিশ্বভ্রমণ শেষে ১০ মে ৬.১৭৫ কেজি ওজনের সোনার ট্রফিটা প্রথম নিয়ে যাওয়া হলো নোবেল শান্তি বিজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকার মহান নেতার কাছে। নির্জন ঘরটায় মুখোমুখি ম্যান্ডেলা ও ফিফা মহাসচিব জেরোম ভালক। মাঝখানে বিশ্বের সবচেয়ে প্রার্থিত সোনালি ট্রফিটা। সেটির দিকে অপলক তাকিয়ে নেতা উদাস হয়ে গেলেন। বললেন, এই ট্রফিটা তাঁদের চাই। দক্ষিণ আফ্রিকার বড় দরকার ট্রফিটা। আমজনতার কথা না-হয় বাদই দেওয়া গেল, দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ লোকটিই তো বিশ্বকাপ জিততে চাইছেন!
শান্তিতে আরেক নোবেলজয়ী দক্ষিণ আফ্রিকান ডেসমন্ড টুটু আশাবাদী, দক্ষিণ আফ্রিকা শুধু আয়োজনের অধিকার পাওয়ার লড়াইয়েই বিজয়ী হয়ে বসে থাকবে না, এই কাপটিও জিতবে। বুঝলেন তো, বিশ্বকাপ ফুটবল কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার বীজ বুনে দেয় মনের মধ্যে! এখানে একজন নোবেলজয়ী আর সাধারণ মানুষের মধ্যে তফাত নেই। এখানে আকবর বাদশার সঙ্গে একজন হরিপদ কেরানি মিলেমিশে একাকার হয়ে যান। জিগীষাই এটির একমাত্র আকাঙ্ক্ষা। অংশগ্রহণের আত্মতৃপ্তি এই পৃথিবীতে অচল।
বাস্তবে দক্ষিণ আফ্রিকার শিরোপা জয়ের সম্ভাবনা আর মঙ্গলগ্রহে ১১ জুলাই, ২০১০ তারিখে প্রাণের অস্তিত্ব আবিষ্কার হওয়া মনে হয় সমান কথা। তাদের পক্ষে বাজির দর ১০০/১। মানে এক টাকা বাজি ধরলে পাওয়া যাবে ১০০ টাকা। দুই সাবেক চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে ও ফ্রান্সের সঙ্গে তারা পড়েছে ‘এ’ গ্রুপে। বাকি প্রতিপক্ষ মেক্সিকো বিশ্ব ফুটবলের মহীরুহ নয়, কিন্তু বড় শক্ত দল, এবার নিয়ে যারা বিশ্বকাপে যাচ্ছে ১৪তম বারের মতো।
তিন গ্রুপ সঙ্গীর দিকে তাকিয়েই আপনি বলে দিতে পারেন, দক্ষিণ আফ্রিকা পত্রপাঠ প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নিচ্ছে। দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠার ওপর বাজি ধরতে গেলেই অনেক স্বপ্নচারী হতে হয়। তার ওপর চ্যাম্পিয়ন! দক্ষিণ আফ্রিকাকে আপাতত বিশ্বকাপ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মূর্তিমান বেমানান মনে হচ্ছে। হ্যাঁ, নেলসন ম্যান্ডেলা, ডেসমন্ড টুটু বা পাহেইরার কাছে আবদার জানানো সেই সব মানুষ ৩০ দিনের প্রতিযোগিতায় লম্বা সময় ধরে স্বপ্ন আঁকতে পারেন কোনো একজন বায়রন মরেনোর দেখা পেলে।
বায়রন মরেনোকে চিনলেন না? সেই যে ইকুয়েডরের আইনজীবী ভদ্রলোক, যিনি বাঁশি হাতে দেজনের মাঠে ২০০২ বিশ্বকাপে ইতালির স্বপ্ন খুন করেছিলেন। ফ্রান্সেসকো টট্টির গোলটা কীভাবে বাতিল করলেন ওই রেফারি, আজও ভেবে পাই না। আট বছর আগে দেজন স্টেডিয়ামের মিডিয়া ট্রিবিউনে বসে দক্ষিণ কোরিয়ার অপ্রত্যাশিত কোয়ার্টার ফাইনাল জয়ের উল্লাস আর ইতালির পরাজয়ের বেদনার সাক্ষী হয়েছিলাম। একটা অঙ্ক সেদিন মেলাতে পারিনি, আজও পারি না। স্বাগতিক দেশের জয়ের সঙ্গে টুর্নামেন্টের ঝলকানির একটা সম্পর্ক না থেকে পারেই না। আর গ্যালারিতে বেশি বেশি দর্শক টানার সমীকরণটা সহজ। স্বাগতিক দলকে যতটা পারো টুর্নামেন্টে ধরে রাখো। প্রয়োজনে একটা ফেবারিটের গর্দান দিয়ে দাও। অবশ্য যাদের বলে আগুন রাঙা ফেবারিট তাদের সুরক্ষা দাও। এমন সমীকরণ মেলাতেই এক একজন দেবদূতের মতো বায়রন মরেনোর আবির্ভাব ঘটে।
এবার কে হবেন বায়রন মরেনো? কোন ফেবারিট দল হবে ইতালির অনুসারী? আফ্রিকার প্রথম বিশ্বকাপে কোরিয়া-জাপানের মতো সমীকরণ এসেও যেতে পারে! চারদিকের নেতিবাচক খবরে বিদেশি ফুটবল পর্যটকেরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। স্বতঃস্ফূর্ত সাম্বা দর্শকের আনাগোনা না হলে সেটা আবার বিশ্বকাপ হলো নাকি! তাই ফিফা সভাপতি সেপ ব্ল্যাটার, আর মহাসচিব জেরোম ভালকে একটি রেকর্ড বাজিয়েই যাচ্ছেন, দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপ হবে সবচেয়ে নিরাপদ! যেন আগের সব বিশ্বকাপ অনিরাপদ পৃথিবীর কোনো দূরতর স্মৃতি হয়ে ছিল। চারদিক থেকে যা আভাস মিলছে, বিশ্বকাপের গ্যালারি ভরাতে হলে দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষই বেশি বেশি ডেকে আনতে হবে। তাদের হাতে তুলে দিতে তীব্র গগনভেদী আওয়াজ তোলা প্লাস্টিকের বাঁশি, ভুভুজেলা যার নাম। ভুভুজেলার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে যদি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিপক্ষ দলগুলো পা হড়কায়। অতি পেশাদার ফুটবলের এই বিশ্ব-সংসারে একটা ‘শব্দভূত’ শক্তিশালী কোনো দলকে হটিয়ে দেবে, এটা ভাবতেও কেমন লাগে! তাহলে? দরকার অন্য কিছু। ফিফা নিশ্চয়ই সমীকরণ মেলাতে বসে গেছে।
তবে যতই সমীকরণ মেলান, বিশ্বকাপ হয়তো চেনা বিজয়ীদের গলাতেই বরমাল্য দেবে। এগিয়ে সেই ব্রাজিল। যারা নিজেদের মহাদেশের বাইরেও ট্রফি জয়ের রাস্তাটা সবচেয়ে ভালো চেনে। নিজেদের মহাদেশের বাইরে প্রথম ফিফা বিশ্বকাপ জিতেছিল কারা? ব্রাজিল (১৯৫৮)। এশিয়ার প্রথম বিশ্বকাপ জিতেছে কারা? ব্রাজিল (২০০২)। এবারও তো মেলানো যায়, আফ্রিকার প্রথম বিশ্বকাপ জিতবে কারা? উত্তরটা আপনি নিজেই বসিয়ে নিতে পারেন। নিজেদের মহাদেশের বাইরে যারা আগে জিতে দেখিয়েছে তারাই জিতবে।
তবে উত্তরটা এবার অত সহজ না-ও হতে পারে। ঘটতে পারে কোনো দেশের ‘বিশ্বকাপ শাপমুক্তি’। অষ্টম কোনো দেশের নামে শিরোপাটা বিশ্বকাপ দেবতা লিখে রেখেছে কি না কে বলতে পারে! মেসি-ম্যারাডোনা রসায়ন আর্জেন্টিনাকে ২৪ বছর পর তৃতীয় শিরোপা এনে দিতেও পারে। ইতালিকে নিয়ে মোটেও শোরগোল নেই। এটাই তাদের সুবিধা। একটা বুড়ো দল নিয়ে পূর্বসূরি ভিত্তোরিও পোজ্জোর মতো টানা দ্বিতীয় শিরোপা লিপ্পি তুলে আনতেও পারেন!
ফুটবলের বিশ্বজনীন চেহারা বিশ্বকাপের জাদুটাকে চুরি করে নিয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন একজন ১৭ বছরের পেলেকে মাটি ফুঁড়ে উদয় হতে দেখবেন না, যিনি ১৯৫৮ সালে সুইডেন বিশ্বকাপে খেলতে এসেই শিরোপা জিতিয়েছিলেন ব্রাজিলকে। স্যাটেলাইট টেলিভিশন তারকাদের ‘ড্রয়িং রুমে’র সম্পদ বানিয়ে ফেলেছে। এখন একজন মেসি, রোনালদো বা রুনিরা হঠাৎ করেই বিশ্বকাপের তারকা হয়ে যান না। অনেক আগেই তাঁরা তারকা। বিশ্বকাপ তাদের শ্রেষ্ঠত্ব তুলে ধরার মঞ্চ মাত্র। মানুষ আসলে ওই শ্রেষ্ঠত্বের আকর্ষণেই ছুটছে। কে সেরা, মেসি না রোনালদো? রোনালদো না রুনি? ব্রাজিলের ষষ্ঠ শিরোপা না ইতালির পঞ্চম? জার্মানির চতুর্থ না আর্জেন্টিনার তৃতীয়? স্পেনের প্রথম না নেদারল্যান্ডের প্রথম? এ রকম করেই মানুষ তার আগ্রহের তাসগুলোকে সাজিয়ে নেয়। একটা কিছু নিয়ে উল্লাস তো করতে হবে! স্বভাবতই সাফল্যপিয়াসী মানুষ ব্যক্তিগত ব্যর্থতা বা রাষ্ট্রীয় হতাশা ভুলতে চায় অন্য সাফল্যের ছবি এঁকে। ফুটবল সেখানে সবচেয়ে বড় ক্যানভাস। তাই নোবেল বিজয়ী নেলসন ম্যান্ডেলা বিশ্বকাপ আয়োজনের মধ্যেই সাফল্য খুঁজে বেড়ান না। তিনি ওই সুন্দর কাপটা হাতে নিতে চান। তবে যেই জিতুক দক্ষিণ আফ্রিকার হাতে ওই কাপ উঠবে না। বিশ্বকাপ অনেক বড়, কিন্তু তার রহস্যের ঘোমটা এত বড় নয়।
No comments:
Post a Comment