ব্যর্থ অভ্যুত্থানের ভয়ঙ্কর ছক
সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি ও অভ্যুত্থানের প্রধান টার্গেট ছিল রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ দুই প্রধান ব্যক্তিসহ ১৩ নাগরিক। তাদের হত্যার মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থান সফল করার নীলনকশা তৈরি করা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন হিট লিস্টের এক নম্বরে। রাষ্ট্রপতি মোঃ জিল্লুর রহমান ছিলেন তিন নম্বরে। হত্যা পরিকল্পনার দু'নম্বরে ছিলেন এক ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তা। হিট লিস্টে থাকা বাকি ১০ জনও সেনা কর্মকর্তা। সেনাবাহিনীর একটি নির্ভরশীল সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সূত্র জানায়, পরিকল্পিতভাবে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ ১১ ঊর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তাকে হত্যার মধ্য দিয়ে বর্তমান সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করার ছক তৈরি করা হয়। যেসব সেনা কর্মকর্তাকে হত্যা করার ছক তৈরি করা হয়েছিল তারা সেনাবাহিনীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে তারা তালিকা তৈরি করে। কোন কর্মকর্তাকে কীভাবে হত্যা করা হবে_ সে ছকও বানানো হয়। কিছু কর্মকর্তাকে জিম্মি করার পরিকল্পনাও ছিল।
এদিকে সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ঘটনায় বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত খুনিদের সম্পৃক্ততার বিষয়ে তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত পলাতক আসামি মেজর শরিফুল ইসলাম ডালিমের (বরখাস্ত) সম্পৃক্ততার বিষয়ে কিছু তথ্য এরই মধ্যে পাওয়া গেছে। ডালিম মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শেখ হাসিনা সরকার সম্পর্কে উস্কানিমূলক লেখা সংবলিত একটি ব্লগ খোলেন।
এদিকে পরিকল্পনাকারী সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিকদের সম্পর্ক খতিয়ে দেখতে একটি টিম কাজ করছে। ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যেসব প্রবাসী নাগরিকের সম্পৃক্ততা থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে, তাদের আর্থিক লেনদেনের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া শুরু হয়েছে। এমনকি সন্দেহভাজন প্রবাসী নাগরিকদের সঙ্গে বাংলাদেশে অবস্থানরত কাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে_ তা বের করতে দুটি বিশেষ টিম কাজ করছে। সন্দেহভাজন কয়েক বেসামরিক নাগরিকের গতিবিধির ওপর নজরদারি রাখা হয়েছে। গত কয়েক মাসে তারা কোন কোন ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলেছেন, তার তালিকা বের করে যাচাই-বাছাই চলছে। পরিকল্পনায় জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে
দেশি-বিদেশি জঙ্গি সংগঠনের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা রয়েছে কি-না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির প্রাথমিক তথ্য পাওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু হয়। এরপর বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নিজস্ব গোয়েন্দা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এসব ঘটনায় জড়িত দু'জনকে গ্রেফতার করা হয়। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ল্যাপটপসহ অন্যান্য তথ্য-উপাত্ত। ল্যাপটপে পাওয়া পুরো পরিকল্পনা।
একটি নির্ভরশীল সূত্র জানায়, পরিকল্পনায় জড়িত সেনা কর্মকর্তা লে. কর্নেল (অব.) এহসান ইউসুফের ল্যাপটপ থেকে এরই মধ্যে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কয়েকটি জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার মতো পর্যাপ্ত তথ্য। এসব তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। হিযবুত তাহ্রীর ও হরকাতুল জিহাদসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে সন্দেহভাজন সেনা কর্মকর্তাদের যোগসূত্রের বিষয়টি গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হচ্ছে। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নেতা মাওলানা ইয়াহিয়ার সঙ্গে কোনো ধর্মান্ধ সেনা কর্মকর্তার যোগাযোগ ছিল কি-না, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করতে সেনাবাহিনীর সাবেক ও বর্তমান কিছু সদস্য অভ্যুত্থানের চেষ্টা চালান। এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন কিছু প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক। কিছু প্রবাসী নাগরিক সম্প্রতি বিভিন্ন নামে যুদ্ধাপরাধীদের পক্ষে সারাবিশ্বে প্রচার চালান। কিছু সংগঠনের ব্যানারে এসব প্রচার চালানো হয়। এসব সংগঠনের বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। ১৩ ডিসেম্বর সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা পরিকল্পনার তথ্য ফাঁস হয়ে যায়। এরপর অভ্যুত্থানচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয় সেনাবাহিনী। অভ্যুত্থানচেষ্টা তদন্তে ২৮ ডিসেম্বর একটি তদন্ত আদালত গঠন করা হয়। এ ঘটনায় ১৯ জানুয়ারি সেনা সদরে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সরকার উৎখাতের অপচেষ্টা দেশবাসীকে জানানো হয়।
মেজর ডালিমের উস্কানি : একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত পলাতক আসামি মেজর ডালিম ওয়েবসাইটে নানা উস্কানিমূলক লেখা পোস্ট করেন। এসব লেখায় মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত এবং বঙ্গবন্ধুর সরকারকে চরমভাবে কটাক্ষ করা হয়।
গণভবনের আশপাশে নিরাপত্তা জোরদার : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবনকেন্দ্রিক পুলিশের নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশের তিন স্তরবিশিষ্ট নিরাপত্তার মধ্যে রয়েছে ৮০ সদস্যবিশিষ্ট আর্মড ব্যাটালিয়ন পুলিশ; যারা প্রতি রাতে ভারী অস্ত্র নিয়ে গণভবনের আশপাশের এলাকায় নিযুক্ত থাকে। পুলিশ বিশেষ পরিকল্পনা নিয়ে বাড়তি নিরাপত্তার অংশ হিসেবে তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে দায়িত্ব পালন করছে। এরই অংশ হিসেবে কিছুদিন ধরে রাত ১১টার পর গণভবনের পাশের সড়ক সাধারণ নাগরিকের চলাচলের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে গণভবনকেন্দ্রিক বাড়তি নজরদারি থাকে রাত ১০টার পর থেকেই। একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের পর ১০ জানুয়ারি থেকে গণভবনকেন্দ্রিক বিশেষ নিরাপত্তায় পুলিশ এ ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছে।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) ইমাম হোসেন সমকালকে বলেন, অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বর্তমানে গণভবনকেন্দ্রিক পুলিশের নিরাপত্তা শক্তিশালী করা হয়েছে। যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে পুলিশ প্রস্তুত।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গণভবনকেন্দ্রিক তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে_ প্রথমত, গণভবনের নিকটতম পুলিশি নিরাপত্তা, মধ্যদূরবর্তী নিরাপত্তা ও দূরবর্তী নিরাপত্তা। দূরবর্তী নিরাপত্তার অংশ হিসেবে প্রতি রাতে পুলিশের বিশেষ তিনটি টিম ভারী অস্ত্রসহ তিনটি এলাকায় টহলে থাকে। এসব এলাকা হলো_ বিজয় সরণি মোড়, আসাদ গেট ও শ্যামলী শিশুমেলা। রাত ১০টার পর তিন প্লাটুন পুলিশ ভাগ হয়ে গোটা এলাকায় অনবরত রাউন্ড দিতে থাকে। এ ছাড়া গণভবনের আশপাশের এলাকায়ও থাকে পুলিশের টহল। গণভবন লাগোয়া চন্দ্রিমা উদ্যানেও বাড়তি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। গণভবনকেন্দ্রিক পুলিশ ফোর্স দ্বিগুণ করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার মূল দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন এসএসএফ ও পিজিআর সদস্যরা। ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানচেষ্টার পর একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদারের সুপারিশ করে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা তদারক করছেন একজন উপকমিশনার (ডিসি) পদমর্যাদার কর্মকর্তা। তাকে সার্বিকভাবে সহযোগিতা করছেন একজন সহকারী কমিশনার (এসি) এবং একজন পরিদর্শক। তাদের সঙ্গে থাকছেন ৬০ পুলিশ সদস্য।
No comments:
Post a Comment