kazi ashraful islam

kazi ashraful islam

Sunday, January 22, 2012

সময় অপচয় আট হাজার মিনিট

সজল জাহিদ
গত তিন বছরে মাত্র তিন দিন নির্ধারিত সময়ে সংসদের কার্যক্রম শুরু করা গেছে। দিনের কার্যক্রমে একটি মিনিটও অপচয় হয়নি_ এমন কার্যদিবস আছে মাত্র একটি। এর মধ্যে এমন একটি দিনও আছে যেদিন নির্ধারিত সময়ের আগেই সংসদ কার্যক্রমে ঢুকতে পেরেছেন স্পিকার। এ ছাড়া তিন বছরে সংসদের ২৫৪ কার্যদিবসের চিত্র
অভিন্ন। কোনো কারণে সংসদ কার্যক্রম কিছুক্ষণের জন্য মুলতবি করা হলেও সেটি পেঁৗছে গেছে দীর্ঘক্ষণে। কোনো কোনো দিন সময় অপচয়ের হিসাব দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত গেছে।
নবম সংসদের প্রথম তিন বছরের ১১টি অধিবেশনের মধ্যে যে ১০টি অধিবেশনের কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত সার প্রকাশিত হয়েছে সেখান থেকে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। তাতে ১০ অধিবেশনের ২৪১ দিনের হিসাবই আমলে নেওয়া সম্ভব। একাদশ অধিবেশনের সংক্ষিপ্ত সার এখনও অপ্রকাশিত।
প্রাপ্ত হিসাবে দেখা গেছে, নবম সংসদের প্রথম ২৪১ দিনের কার্যক্রমে সব মিলিয়ে সময় অপচয় হয়েছে ৭ হাজার ৭৭৫ মিনিট। গড়ে প্রতিটি কার্যদিবসে অপচয় সাড়ে ৩২ মিনিট। এর মধ্যে কোরাম না হওয়ায় সব দিনের শুরুতেই স্পিকারের পক্ষে নির্ধারিত সময়ে অধিবেশন কক্ষে আসা সম্ভব হয়নি। আবার মাগরিব বা আসরের নামাজের জন্য ২০ বা ৩০ মিনিটের বিরতি (মুলতবি) দিলেও সে বিরতি ৪০ বা ৫০ মিনিটও পেরিয়েছে। নামাজের বিরতির পর এক ঘণ্টার মধ্যে কোরাম পূরণ হয়নি_ এমন দিনও পাওয়া গেছে তিন বছরের সংসদে। নির্ধারিত সময়ে শুরু করতে না পারা, নামাজের বিরতিসহ অন্যান্য বিরতি মিলিয়ে গড়ে একেকটি বিরতিতে সংসদের সময় অপচয় দাঁড়িয়েছে গড়ে ১৭ দশমিক ২০ মিনিট।
সংসদ কার্যক্রমে দীর্ঘ সময় নষ্টের কারণে অর্থ অপচয়ের হিসাবও অনেক বড় হবে। সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে অধিবেশন চলাকালে জাতীয় সংসদের সরাসরি ব্যয়সহ আনুষঙ্গিক খরচের পরিমাণ মিনিটে ৩০ হাজার টাকা। তাতে তিন বছরে ৮ হাজার মিনিট কোনো কাজে না লাগায় অপচয়ের হিসাব দাঁড়ায় আড়াই লাখ কোটি টাকায়। এদিকে সময় অপচয়ের হিসাবকে এমনভাবে টাকায় পরিমাপ করার কোনো সুযোগ নেই বলে দাবি করেন অনেকে। জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ উপাধ্যক্ষ মোঃ আবদুস শহীদ বলেন, এভাবে ব্যাখ্যা করলে অন্য অনেক ক্ষেত্রে আরও লাখ লাখ কোটি টাকা অপচয়ের হিসাব আনা যাবে। সংসদ যে নির্ধারিত সময় মেনে শুরু হতে পারেনি_ এ বিষয়টি অবশ্য অস্বীকার করেননি তিনি।
নবম সংসদের প্রথম অধিবেশনে ৩৯ কার্যদিবসেই ১ হাজার ৫৪৬ মিনিট অপচয়ের হিসাব মিলেছে। সবচেয়ে বেশি অপচয় হয়েছে চতুর্থ অধিবেশনে। সেটি ছিল এই সংসদের দ্বিতীয় বছরের প্রথম অধিবেশন। ২০১০ সালের ৪ জানুয়ারি শুরু হয়ে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত চলা ৩৯ কার্যদিবসের অধিবেশনে ১ হাজার ৬২২ মিনিট অপচয় হয়। পঞ্চম অধিবেশনে সময় অপচয় হয়েছে ১ হাজার ১৪৪ মিনিট। এ তিনটি অধিবেশনের মধ্যে দুটিই বছরের প্রথম অধিবেশন। অন্যটি বাজেট অধিবেশন। সাধারণত এ অধিবেশনগুলো দীর্ঘ হয়। তাতে সাংসদদের উপস্থিতি বা সংসদ কার্যে অংশ নেওয়ার বিষয়টিও অনেক ক্ষেত্রে একঘেয়ে এবং নিয়ম রক্ষায় পরিণত হয়।
এর বাইরে নানা কারণে দ্বিতীয় অধিবেশনে ৮৯৩, নবম অধিবেশনে ৭৮৭, অষ্টম অধিবেশনে ৭৫২, তৃতীয় অধিবেশনে ৪৫৮, ষষ্ঠ অধিবেশনে ৪১৯, সপ্তম অধিবেশনে ২১৫ এবং দশম অধিবেশনে ৩১ মিনিট অপচয় হয়।
দেখা গেছে, অধিকাংশ সময় মাগরিবের নামাজের বিরতির পর অধিবেশন কক্ষে ফিরতে গড়িমসি করেন সাংসদরা। মাগরিবের নির্ধারিত বিরতি বাদ দিয়ে এখানে অপচয় ৩ হাজার ২৭৬ মিনিট। আর দিনের কার্যক্রম শুরু করতে বিলম্ব বা দু'বেলার অধিবেশনের ক্ষেত্রে বিকেলের কার্যক্রম শুরু করতে বিলম্ব করায় অপচয় ৩ হাজার ১৩২ মিনিট। অন্যদিকে আসরের নামাজের ২০ মিনিটের নির্ধারিত বিরতির বাইরেও সাংসদদের বিলম্বে অপচয় আরও ১ হাজার ৪৯৯ মিনিট।
সংসদ কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত সারে দেখা যায়, ২০০৯ সালের ৭ জুন সংসদের অধিবেশন বসার জন্য নির্ধারিত সময় ছিল বিকেল ৪টা। আগের দিন সময় নির্ধারণ হলেও ৭ জুন দুপুরের পর স্পিকার নিজ ক্ষমতাবলে সময় সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় পুনর্নির্ধারণ করেন। পুনর্নির্ধারিত সময়েও সাংসদরা আসতে পারেননি। অবশ্য এক্ষেত্রে সময় অপচয়ের হিসাব ধরা হয়েছে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা থেকেই। ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি সংসদের কার্যক্রম শুরু হয় ৪৫ মিনিট বিলম্বে। প্রথম বছরের ২৮ জুন এক দিনে ৭০ মিনিট নষ্ট হয়। একই বছরের ২ ও ৫ মার্চ অপচয় হয় ৬৬ মিনিট করে।
গত বছর ৩ মার্চ মাগরিবের নামাজের পর সামনের সারির ২৯ আসনের কোনো সাংসদই উপস্থিত ছিলেন না। ২০০৯ সালের ২৮ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৫টায় সংসদ বসার সময় নির্ধারিত হলেও তা ৫টা ২৯ মিনিটে শুরু হয়। ২০১১ সালের ১৪ মার্চ কোনো সময় অপচয় ছাড়াই দিনের কার্যক্রম শেষ হয়। ওইদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সংসদের কার্যক্রম চলে।
তারও আগে নবম সংসদের প্রথম দিন থেকেই শুরু হয় সময় নষ্টের পর্ব। সংসদের নথি অনুসারে সেদিন ৬৭ মিনিট নষ্ট হয়। বিকেল ৩টার অধিবেশন বসে ১৬ মিনিট বিলম্বে। অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্নের পর নতুন স্পিকারের শপথের জন্য বরাদ্দ ছিল ৩০ মিনিট। দেখা গেল ৭১ মিনিট পরও কোরাম পূরণ হচ্ছে না। মাগরিবের নামাজের ২০ মিনিটের বিরতিও সেদিন প্রলম্বিত হয়েছিল। মাগরিবের নামাজের দীর্ঘায়িত বিরতি চলে ২০০৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি। ওইদিন নির্ধারিত ২০ মিনিট পরও ৪০ মিনিট অনির্ধারিত বিরতি চালিয়ে নেন সাংসদরা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সংসদের বাজেট যখন ৪৫ কোটি টাকা, তখনই মিনিটে ১৯ হাজার টাকা খরচের হিসাব ছিল। এখন এ বাজেট কয়েকগুণ বাড়ায় প্রতি মিনিটের খরচ ৩০ হাজার টাকা। তা ছাড়া মিনিটপ্রতি খরচের হিসাবে কেবল সংসদের খরচের হিসাব হয় না। প্রত্যেক সাংসদের বেতন-ভাতা, মন্ত্রীদের স্টাফ-গাড়ি-অফিসসহ সব খরচ যুক্ত হয়। একই সঙ্গে বিদ্যুৎ, গণপূর্ত, টেলিফোন, ফায়ার সার্ভিস, মেডিকেলসহ সব খরচ যোগ করে প্রতি মিনিটের হিসাব নির্ধারিত হয়। সে কারণে সময় অপচয়ের হিসাব বড় হলে টাকার অঙ্ক আরও বড় মনে হয়। এর আগে এ সংসদের প্রথম বছরের ওপর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ এমন হিসাব প্রকাশ করায় ক্ষুব্ধ হয়েছিল সংসদ ও সরকার।
সংসদের বেশ ক'জন সিনিয়র স্টাফ বলেন, রুলস অব প্রসিডিউরে এ বিষয়ে কিছু পরিবর্তন এনে সময় অপচয় থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, সময় অপচয় অবশ্যই গর্হিত কাজ। তিনি বলেন, যেটুকু সময় ব্যবহার হচ্ছে বলে দেখানো হয় তাও সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে কাজে লাগাতে হবে।

No comments:

Post a Comment